ভারতের আন্দামান দ্বীপে ১৪৩ জন রোহিঙ্গাসহ নৌকা আটক

fec-image

ভারতের আন্দামান-নিকোবরে দ্বীপপুঞ্জের কাছে ১৪৩ জন রোহিঙ্গা বোঝাই একটি নৌকা আটক করেছে পুলিশ ও উপকূলীয় নিরাপত্তা বাহিনী। কয়েক সপ্তাহ ধরে সাগরে ভাসছিল ওই নৌকাটি।

শেষপর্যন্ত আন্দামান-নিকোবর পুলিশ ২৪ ডিসেম্বর তাদের উদ্ধার করে পোর্টব্লেয়ারের একটি আশ্রয় শিবিরে রেখেছে। দিল্লি থেকে কেন্দ্রীয় সরকার পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত শরণার্থীদের অস্থায়ী শিবিরেই রাখার কথা বলা হয়েছে।

নৌকার রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের কক্সবাজার ক্যাম্প থেকে ইন্দোনেশিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিল বলে জানা যাচ্ছে।

দক্ষিণ আন্দামানের পোথ্রাপুর ব্লকের বিজেপি প্রধান পিঙ্কি দাস ঘটনার সত্যতা করে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘২৪শে ডিসেম্বর একটি নৌকায় সওয়ার হয়ে রোহিঙ্গাদের একটি দলকে উদ্ধার করা হয়েছে।’

প্রসঙ্গত, গত ২৩ ডিসেম্বর, ইউনাইটেড নেশনস হাই কমিশনার ফর রিফিউজিস (ইউএনইচসিআর) ভারতসহ একাধিক দেশের কাছে রোহিঙ্গাদের উদ্ধারের অনুরোধ করেছিল যারা প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় চেপে ইন্দোনেশিয়ার দিকে রওনা হয়েছে, তাদের উদ্ধারের বিষয়টিতে জোর দিতে। পরে, শরণার্থী বোঝাই ওই নৌকা উদ্ধারের ঘটনায় ভারতের মানবিক অবস্থানের উল্লেখ করে ধ্যবাদ জানিয়েছে ইউএনইচসিআর।

শহীদ দ্বীপের (যা আগে নিল আইল্যান্ড নামে পরিচিত ছিল) স্থানীয় মানুষ প্রথমে ওই নৌকাকে দেখতে পান। ক্রমশ তীরের কাছাকাছি আসতে থাকলে চিন্তিত হয়ে পড়েন স্থানীয় বাসিন্দারা। তারাই পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। একই সঙ্গে উপকূলীয় নিরাপত্তা বাহিনীও লক্ষ্য রাখছিল বিষয়টিতে।

উদ্ধারের কাজে সামিল ছিলেন এমন এক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ইঞ্জিন বিকল হয়ে যাওয়ায় শহীদ দ্বীপের কাছে আটকে পড়েছিলেন নৌকায় সওয়ার মানুষেরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই আধিকারিক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘স্থানীয় মানুষের সাহায্যে ওই নৌকাটির কথা জানতে পারি। রবিবার সকাল ৮টা নাগাদ আমাদের একটি দল শহীদ দ্বীপের তীরে গিয়ে পৌঁছায়। সেখানে গিয়ে আমরা দেখি ১৪৩ জন রোহিঙ্গা ওই নৌকায় রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে নারী ও শিশুদের সংখ্যা চোখে পড়ার মতো ছিল।’

স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে জিজ্ঞাসা করা হলে নৌকায় সওয়ার মানুষেরা জানান, তারা ইন্দোনেশিয়া যেতে চান। পথে ইঞ্জিন খারাপ হয়ে যাওয়ার পর তারা দিকভ্রষ্ট হয়ে পড়েন।

‘রোহিঙ্গাদের ওই দলটি বাংলাদেশ থেকে দিন ১৪-১৫ আগে বেরিয়েছিল বলে জানিয়েছেন। নৌকায় বাংলাদেশের পতাকা লাগানো ছিল। জিজ্ঞাসা করে জানতে পারি, ইন্দোনেশিয়া যেতে চাইছিলেন তারা,’ বলেছেন ওই আধিকারিক।

ওই আধিকারিক আরও জানিয়েছেন, মাঝ সমুদ্রে বিপদের মুখে পড়া কয়েকজন রোহিঙ্গাকেও (যারা অন্য নৌকোয় ছিলেন) ঠাঁই দিয়েছিল, এই নৌকাটিতে সওয়ার মানুষেরা। আপাতত, তাদের সবাইকে পোর্ট ব্লেয়ারের কাছে একটি অস্থায়ী ক্যাম্পে রাখা হয়েছে স্থানীয় প্রশাসনের তরফে আন্দামানে এসে পড়া রোহিঙ্গাদের সাস্থ্য এবং সুরক্ষার ব্যাপারে কড়া নজর রাখা হয়েছে।

‘খিদে পেয়েছে, কিছু খাবার হবে?

সীতাপুর গ্রামের বাসিন্দা কাজল দাস এই পুরো ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘২৪শে ডিসেম্বর সকালে আমি দোকানে ছিলাম। হঠাৎ আমার এক পরিচিত সেদিন ফোন করে বলেন, লোক বোঝাই নৌকাকে তীরের কাছে আসতে দেখা যাচ্ছে। আমি প্রথমে পুলিশকে ফোন করার চেষ্টা করি কিন্তু লাইন না পাওয়ায় স্থানীয় থানায় দৌড়ে যাই। সেখানে কর্তব্যরত পুলিশ আধিকারিককে পুরো বিষয়টি জানাই।

‘ততক্ষণে শহীদ দ্বীপে আমার যে পরিচিত থাকেন, তিনি ঘনঘন ফোন করে চলেছেন। আমি কোনো মতে সেখানে পৌঁছে দেখি নৌকা থেকে লোক নামা শুরু করে দিয়েছে। আমরা প্রথমে ভয় পেয়েছিলাম নৌকা করে সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী হানা দিল কি না। পরে জানতে পারি নৌকায় রয়েছে শরণার্থী। তাদের মধ্যে একাধিক শিশু ছিল।’

‘ওই নৌকায় কয়েকমাস থেকে ১০ বছরের মধ্যে ২০-২১টি শিশু ছিল। নৌকায় সওয়ার যাত্রীরা কেউই প্রায় ৬-৭ দিন ধরে কিছু খাননি। আমাদের দেখে কেউ কেউ বললেন- খিদে পেয়েছে, কিছু খাবার হবে? সে দৃশ্য দেখলে চোখে জল আসে। গ্রামের লোকেরা নারী ও শিশুদের জন্য তড়িঘড়ি খাবার নিয়ে আসে। দুপুরে আমরা তাদের জন্য খিচুড়িও রান্না করি। পরে তাঁদের পুলিশ ও উপকূলের নিরাপত্তা বাহিনী পোর্ট ব্লেয়ার নিয়ে যায়,’ কাজল বলেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপকূলীয় নিরাপত্তা বাহিনীর এক আধিকারিক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সম্প্রতি আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে একাধিকবার রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকা এসে পড়ায়, উপকূলের দিকে কড়া নজর রেখেছে উপকূলীয় নিরাপত্তা বাহিনী। আপাতত কড়া নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে রাখা হয়েছে তাদের। কেন্দ্র থেকে কোনও নির্দেশ না আসা পর্যন্ত এখানেই থাকবেন তারা।’

তবে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে এই ঘটনা নতুন নয়। একাধিকবার রোহিঙ্গা শরণার্থী বোঝাই নৌকা এসে পৌঁছেছে আন্দামানে।

ওই আধিকারিকের কথায়, ‘বাংলাদেশ থেকে এর আগেও রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মানুষ আন্দামানের কয়েকটি দ্বীপে এসে পৌঁছেছিলেন। শরণার্থী শিবিরে হিংসাত্মক ঘটনার জেরেই এরা পালিয়ে আসতে বাধ্য হন। এদের বেশিরভাগই মাঝ সমুদ্রে আবহাওয়া বা নৌকার যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিপদে পড়েন। তবে সবাই যে ভাগ্যক্রমে তীরে এসে পৌঁছান বা তাদের উদ্ধার করা সম্ভব হয় এমনটা নয়।’

সাহায্যের আবেদন

আন্দামানে এসে পৌঁছানো নৌকায় সওয়ার এক যাত্রীর আত্মীয়রা তার সঙ্গে যোগাযোগ না করতে পেরে দ্বারস্থ হয়েছিলেন, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘রোহিঙ্গা হিউম্যান রাইটস ইনিসিয়েটিভ’ এর যুগ্ম প্রধান আলি জোহারের।

জোহার বলেন, ‘এই নৌকা সম্পর্কে আমরা প্রথম জানতে পারি যখন তাতে সওয়ার এক ব্যক্তির আত্মীয় মালয়েশিয়া থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, ঝড়ের কারণে মাঝ সমুদ্রে দিকভ্রষ্ট হয়ে পড়ে নৌকাটি।’

‘তারপর থেকেই আমরা ক্রমাগত চেষ্টা করছিলাম, কোনোভাবে যদি যোগাযোগ করা যায় তাদের সঙ্গে। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। আন্দামানের শহীদ দ্বীপে তাদের উদ্ধার করা গিয়েছে এই খবরটি সবে জানতে পারলাম। নিশ্চিত লাগছে।’

প্রসঙ্গত দিন কয়েক আগেই, ইউএনএইচসিআর জানিয়েছিল, ভারতসহ একাধিক দেশকে অনুরোধ করেছিল তাদের উপকূলবর্তী রাজ্যগুলির ওপর নজর রাখতে। জাতিসংঘের ওই সংস্থা জানিয়েছিল, ‘জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় সওয়ার রোহিঙ্গাদের একাধিক নৌকো মাঝ সমুদ্রে বিপদে পড়েছে। সময় মত উদ্ধার না করলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে।’

প্রসঙ্গত, মিয়ানমারে নির্যাতিত হাজার হাজার মুসলিম রোহিঙ্গা প্রতি বছর তাদের দেশ ও বাংলাদেশের শরণার্থী শিবির থেকে ঝুঁকিপূর্ণ সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ায় প্রবেশের চেষ্টা করে। ইউএনএইচসিআর-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা ঝুঁকিপূর্ণ ভাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে যাওয়ার চেষ্টা করেছে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: আটক, আন্দামান দ্বীপ, ভারত
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন