রাতে কাপ্তাই লেকে হারিয়ে যাওয়া লোককে উদ্ধার করা কতোটা কঠিন সে অভিজ্ঞতা হলো

আ ল ম ফজলুর রহমান

(২৩)

১৯৮৬ সালে কাপ্তাই লেকের পানি অসম্ভব কমে যায়। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে স্পিডবোট নিয়ে ঐ সময় কাপ্তাই লেকে খুব ধীর গতিতে চলতে হতো। হঠাৎ একদিন সংবাদ আসলো একজন স্পিডবোট চালক সৈনিক নিহত হয়েছে।

ঐ সৈনিক ব্রিগেড সদর থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে আমার ব্যটালিয়ানে আসছিলো। সে খুব সম্ভবতঃ দ্রুত গতিতে ষ্পিডবোট চালাচ্ছিলো ফলে লেকে পানি কম থাকার কারণে ষ্পিডবোটের ফ্যান ডুবো গাছের সাথে সজোরে ধাক্কা খেয়ে সমস্ত মেশিন উল্টে চালক সৈনিকের উপরে পড়ে এবং মেশিনের ঘূর্ণায়মান ফ্যান সৈনিকের মাথাকে সম্পূর্ন ক্রাশ করে ফেলে। ফলে তার মাথার ঘিলু সমস্ত স্পিডবোটে ছড়িয়ে পড়ে।

আমি অন্য একটি স্পিডবোটে করে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি ঐ সৈনিককে হেলিকপ্টারে করে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের কম্বাইন্ড মিলিটারী হসপিটালে (সি এম এইচ) ইতিমধ্যেই সরিয়ে নেয়া হয়েছে। দেখলাম সমস্ত স্পিডবোটে সৈনিকের মাথার মগজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এমন দৃশ্য দেখার মতো নয়।

একদিনের ঘটনা এখানে বলছি। স্পিডবোট চালক সৈনিকের মর্মান্তিক মৃত্যুর পরে আমরা স্পিডবোট চলাচলের ব্যাপারে অতিমাত্রায় সাবধানতা অবলম্বন করলাম। একদিন রাঙ্গামাটিতে ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে কনফারেন্স শেষে একটু পড়ন্ত বেলায় রাঙামাটি থেকে বারবুনিয়ার উদ্দেশ্য যাত্রা করলাম। আমার সাথে চারজন স্কট এবং একজন জুনিয়র অফিসার।

আমার ধারণা ছিলো ধীর গতিতে গেলেও আমরা সন্ধ্যায় বারবুনিয়া ব্যাটালিয়ান সদরে পৌছতে পারবো। রওয়ানা করলাম। বড় কাঠতলী পৌঁছতে সন্ধ্যা নামে নামে হয়ে গেলো। আমি কনফিডেন্ট ছিলাম একটু দেরী হলেও অসুবিধা হবেনা। ঠিকই পৌঁছে যাবো। সামরিক বাহিনীতে প্রাক্টিক্যালি সব করা হয়।

অভিজ্ঞতা নাই অথচ আন্দাজ করে কোনো কাজ করাকে এনকারেজ করা হয় না। এই জন্যই সেনাবাহিনীতে কোন কাজ করার আগে এপ্রিসিয়েশন করা হয় এবং সেই কাজ যদি কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় হয় তবে সেই এলাকায় রিকোন্যায়সেন্স পরিচালনা করে তবেই পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। আমার পূর্বে কাপ্তাই লেকে রাতে চলাচলের কোনো অভিজ্ঞতা ছিলো না। বারবুনিয়া থেকে দুই কিলোমিটার দুরত্বে থাকতে সন্ধ্যা নেমে এলো। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে সব কিছুই পরিবর্তন হয়ে গেল।

আমরা দেখছি চারিদিকে বাতি জ্বলছে । দিকও কেমন যেন পরিবর্তিত হয়ে গেলো। কোনদিকে বারবুনিয়া আমরা ঠিক করতে পারছিলাম না। কয়েকবার ষ্পিডবোট চালানোর চেষ্টা করে দেখলাম ষ্পিডবোট আইল্যান্ডে ধাক্কা খাচ্ছে। আমরা সামনে, পিছনে, ডাইনে এবং বামে কোনো দিকেই যেতে পারছিলাম না। আমরা এক জায়গায় সীমিত হয়ে পড়লাম। ইতিমধ্যে আমি ওয়্যারলেস সেটে ব্যাটালিয়ান সদরে কথা বলে আমাদেরকে রেসকিউ করতে বললাম।

ব্যাটালিয়ান সদর থেকে বেশ কয়টি রেসকিউ টিম বের হয়ে আমাদের খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিলো। রাতে কাপ্তাই লেকের মতো বিশাল জলরাশির মধ্যে হারিয়ে যাওয়া কাউকে রেসকিউ করা যে কি কঠিন এবং সময়সাধ্য কাজ সেদিন আমি নিজে হাতে কলমে জেনেছিলাম।

আমার অভিজ্ঞতা হলো, রাতে এই রকম বিশাল জলরাশির মধ্যে হারিয়ে যাওয়া মানুষ কনফিউজড হয়ে যায়। এবং যারা রেসকিউ করতে আসে তাদের পক্ষেও যারা হারিয়ে গেছে তাদের অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। আওয়াজ দিলে সেই শব্দ কোন দিক থেকে আসছে তাও নির্ণয় করা সম্ভব হয় না।

মনে হতে পারে কেউ হাতে কোনো মশাল, টর্চ লাইট কিংবা হারিকেন উঁচু করে নিয়ে যদি আসে তো দেখা যাবে সে কোন দিক থেকে আসছে। না এটা ঠিক নয়। ঢেউয়ের মাঝে সব আলোকেই আন্দোলিত হতে দেখা যায়।কত দুরে ঐ আলো এবং কোন দিকে তা নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। যাইহোক রাত প্রায় দশটার দিকে একটি রেসকিউ পার্টি আমাদেরকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়।

একদিন সকালে আমি বরোবুনিয়াতে আমার অফিসে কাজ করছি। এমন সময় সৈনিক রানার আমাকে জানালো যে তিনজন কাঠ ব্যবসায়ী আমার সাথে দেখা করতে চায়। আমি তাদের আসতে বললাম। তারা জানালো যে গতকাল তাদের একটি কাঠ বোঝাই নৌকা শান্তিবাহিনী চাঁদা না দেয়ার জন্য আটক করে ছোট কাঠতলীর পশ্চিমে পাহাড়ের ঢালে ভিতরে আটকে রেখেছে।

শান্তিবাহিনী বলেছে তারা চাঁদার জন্য রাতে আসবে যদি চাঁদা না পায় তবে নৌকাটি কাঠ সহ জ্বালিয়ে দিবে। আমি তৎক্ষণাৎ স্পিডবোটে ওদের নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখলাম একটি কাঠ বোঝাই বড় নৌকা কাপ্তাই লেক থেকে একটি খাড়ি পাহাড়ের ভিতরে গিয়ে একটি মাঝারি সাইজের পুকুরের মতো সৃষ্টি করেছে তারি দক্ষিণ পাড়ে নৌকাটি ভিড়ানো আছে। আমি আরো দেখতে পেলাম পুকুরের পূর্ব পাড়ে একটি বাঙালী বাড়ী।

আমি বাড়ির লোকজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, এটা এক হাজি সাহেবের বাড়ী। কয়েক পুরুষ ধরে তারা এখানে বসবাস করে আসছে। আমি স্পিডবোট নিয়ে কাছের আমার ব্যটালিয়ানের একটি ক্যাম্পে গিয়ে রাতে শান্তিবাহিনীকে কাঠ বোঝাই নৌকার কাছে এম্বুশ করার জন্য তৈরী করে ব্রিগেড সদরে ওয়্যারলেসে মেসেজ দিলাম। ব্রিগেড সদর থেকে আমাকে জানানো হল যে, ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার এই অপারেশনের দায়িত্ব নিচ্ছে এবং ব্রিগেডের কমান্ডে এই অপারেশন পরিচালিত হবে। আমি অনেক বুঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ইউনিটে ফিরে এসে হতোদ্যম হয়ে বসে থাকলাম। ভোর চারটার দিকে ঐ এলাকা থেকে ভীষণ গোলাগুলির শব্দ ভেসে আসতে লাগলো।

সকালে আমাকে জানানো হলো শান্তিবাহিনী চাঁদা নিতে কাঠ বোঝাই নৌকার কাছে এসেছিলো কিন্তু শান্তিবাহিনীর কাউকে আহত, নিহত বা জীবন্ত আটক করা সম্ভব হয় নাই। তবে শান্তিবাহিনী যে নৌকা করে ঘটনাস্থলে আসে সেটা ফেলে তারা পালিয়ে যায়। পরে শান্তিবাহিনী ফেলে যাওয়া নৌকা থেকে অনেক চাঁদা আদায়ের রশীদ, বিভিন্ন ডকুমেন্ট এবং অনেক যুদ্ধের সাজসরঞ্জাম পাওয়া যায়।যেগুলো আমি পরে ব্রিগেড সদর পাঠিয়ে দেই।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন