শান্তিচুক্তিতে নিজেদের উপজাতি উল্লেখ করতে বাধ্য হয়েছিলাম- সন্তু লারমা

fec-image

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) বলেছেন, আমরা নিজেদের প্রকৃত যে পরিচিতি দাবি করি সেই হিসেবে পার্বত্য শান্তিচুক্তিতে আমরা স্বীকৃতি পেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমাদের দেশের সরকার বা শাসকগোষ্ঠী সেভাবে আমাদের মেনে নিতে প্রস্তত ছিলো না। ব্রিটিশ উপনিবেশ শাসনামলে আমাদের যে পরিচিতি দেওয়া হয়েছিলো সেটি আমরা চুক্তিতে উল্লেখ করতে বাধ্য হয়েছিলাম। (তবে সন্তু লারমার এ বক্তব্যের বিরোধিতা করে রাঙামাটিতে আয়োজিত এক সমাবেশে সংসদ সদস্য দীপঙ্কর তালুকদার বলেছিলেন, শান্তিচুক্তির সময় তিনি আদিবাসী শব্দের পরিবর্তে উপজাতি শব্দ ব্যবহারের জন্য সন্তু লারমাকে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু সন্তু লারমা সে অনুরোধ প্রত্যাখান করে বলেছিলেন, কিসের আদিবাসী, আমরা সকলে উপজাতি।)

শনিবার (৩ আগস্ট) রাজধানীর হোটেল সুন্দরবনে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস ২০১৯ উপলক্ষে আয়োজিত বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সংবাদ সম্মেলনে পার্বত্যনিউজডটকমের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।

তিনি বলেন, আমাদের বুঝতে হবে আদিবাসী কোন জাতির নাম না। আদিবাসী হচ্ছে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ধারণ করে যারা বসবাস করছে, সেই বিশেষ বৈশিষ্ট্যমন্ডিত জনগোষ্ঠীরাই হলো আদিবাসী। সে হিসেবে পার্বত্য অঞ্চলে বসবাস করা এই ১৪টি জাতিগোষ্ঠী আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং পার্বত্য নিউজডটকমকে বলেছেন, উপজাতি বলা মানে হচ্ছে একটু নিচু করে দেওয়া। আমি জাতি, তুমি উপ-জাতি এরকম করে দেখা হয়। উপ কেন, আমরা একেকটি জাতি।

তিনি বলেন, ইংরেজি INDIGENOUS PEOPLE –এর যে বৈশিষ্ট্য যারা আধুনিক জাতিরাষ্ট্র হওয়ার সময় বঞ্চিত ছিলো। ভূমির সঙ্গে, পাহাড় ও প্রকৃতির সঙ্গে যাদের জীবন, সারা পৃথিবীতে তাদের ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে INDIGENOUS PEOPLE। আমাদের দেশে এ সমস্যাটা হয়েছে ২০১১ সালে যখন পঞ্চদশ সংশোধনী হয় তখন থেকে। এর আগে আমাদের এত প্রশ্ন মোকাবিলা করতে হয়নি।

এ সংশোধনীর সময় সেখানে বলা হয়েছে উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়। আমরা সেটা গ্রহণ করিনি। আমরা বলছি আলাদা আলাদা জাতির কথা, সেখানে আমাদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। জাতিসংঘ তো নৃগোষ্ঠী দিবস পালন করবে না। তারা পালন করবে ইন্টারন্যাশনাল ডে অব দ্যা ওয়ার্ল্ড ইনডিজেনাস পিপলস। আমাদের দেশ যদি এর স্বীকৃতি দেই, তাহলে এটা বড় মনের পরিচয় দেবো।

এ সময় সংবাদ সম্মেলনে সন্তু লারমা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়ন ও এ সংক্রান্ত রোডম্যাপ ঘোষণা, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ২০০৭ সালে গৃহিত আদিবাসী অধিকারবিষয়ক ঘোষণাপত্র অনুসমর্থন ও বাস্তবায়ন করা, আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাসকর্তৃক আদিবাসী অধিকার আইন প্রণয়ন, জাতিসংঘ ঘোষিত ৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করাসহ ১৩টি দাবি তুলে ধরেন।

সংবাদ সম্মেলনে আগামী ৯ আগস্ট জাতিসংঘ ঘোষিত ২৫তম আদিবাসী দিবস উদযাপন উপলক্ষে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম ৫ আগস্ট আদিবাসী দিবস পালন করার ঘোষণা দেয়। এ লক্ষে তারা বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।

কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে: ৪ আগস্ট সকাল ১০টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টারে আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাসের আলোচনা সভা। ৫ আগস্ট সকাল ১০টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের মূল অনুষ্ঠান-সমাবেশ, র‌্যালি ও সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান উদ্বোধন করবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রাক্তণ চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান।

৭ আগস্ট সকাল ১০টায় ঢাকার ডব্লিউ ভি এ মিলনায়তনে বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক ও বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের যৌথ আয়োজনে আদিবাসী নারীর অধিকারবিষয়ক সেমিনার ও ৯ আগস্ট বেলা ২টায় বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বকুলতলায় ছাত্র সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে।

২৭ আগস্ট এএলআরডি ও ১০টির অধিক সংগঠন মিলিতভাবে আদিবাসীদের ভূমি অধিকার নিয়ে সেমিনার আয়োজন করবে ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে।

এছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলায় ও উপজেলায় যেমন-রাজশাহী, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, ঠাকুরগাঁও, ময়মনসিংহ, রাজবাড়ী, টাঙ্গাইল (মধুপুর), গাজীপুর, নেত্রকোনা, সিলেট, মৌলভীবাজার, শেরপুর, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, সাতক্ষীরা, কক্সবাজার, প্রভৃতি স্থানে আদিবাসী দিবস উদযাপন করা হবে বলে জানানো হয়।

সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, আদিবাসী ভাষা চর্চা ও সংরক্ষণে এগিয়ে আসুন- এ শ্লোগানকে সামনে রেখে এবারের প্রতিপাদ্য নির্বাচন করা হয়েছে। এবারের এ দিবসের দাবি হচ্ছে- আদিবাসীদের মাতৃভাষা সংরক্ষণ ও বিকাশের লক্ষে জাতীয় পর্যায়ে একটি আদিবাসী ভাষা ও সংস্কৃতি একাডেমি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ লক্ষে আদিবাসী সাংস্কৃতিক একাডেমিসমূহ যাতে আদিবাসী ভাষা চর্চা, সংরক্ষণ ও বিকাশের জন্য কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে তার জন্য বাজেট বরাদ্দসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে হবে।

সংবাদ সম্মেলনে আইইডি’র নির্বাহী পরিচালক নুমান আহম্মদ খান, আদিবাসী ফোরামের সহ সভাপতি অজয় এ মৃ, আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাস এর টেকনোক্র্যাট সদস্য জান্নাতুল ফেরদাউস লাকি প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: আদিবাসী, উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন