সমস্যায় পড়েছে মিয়ানমারের রাখাইন পরিকল্পনা

পার্বত্যনিউজ ডেস্ক:

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের জন্য তৈরি অং সান সু চি’র বেসামরিক উদ্যোগ ইতোমধ্যেই ঝামেলায় পড়ে গেছে। চরমপন্থী সন্ন্যাসী অশিন বিরাথুর নেতৃত্বোধীন উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীরা গত দুই মাসে পালিয়ে যাওয়া মুসলিম উদ্বাস্তুদের দেশে ফেরত আনার তীব্র বিরোধিতা করছে। রোহিঙ্গাদের পালিয়ে যাওয়ার ফলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, সেটাকে জাতিসংঘ বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সঙ্কট হিসেবে অভিহিত করেছে।

গত রোববার (২২ অক্টোবর) কয়েক শ’ বিক্ষোভকারী রাখাইনের রাজধানী সিত্তুই’য়ে মিছিল করে দাবি জানায়, নাগরিক না হলে কোনো মুসলিম রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুকে যেন না ফেরানো হয়। অন্যদিকে রাজধানী নেপিদো’য় কয়েক হাজার লোক, তাদের অনেকে দেশটির বেসামরিক নেত্রী সু চির ছবি-সংবলিত পোশাক পরেছিল বা বহন করছিল, রোহিঙ্গা সঙ্কটে সরকারের ভূমিকার প্রতি সমর্থন জানিয়ে সমাবেশ করে।

রাখাইনের বেশির ভাগ রোহিঙ্গা কয়েক প্রজন্ম ধরে সেখানে বাস করলেও রাষ্ট্রহীন। সরকার এবং মিয়ানমারের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিগোষ্ঠী বামাররা তাদেরকে বাঙ্গালি হিসেবে অভিহিত করে। তারা বলছে, এসব লোক বাংলাদেশ থেকে এসেছে। সরকারের জাতিগত তালিকায় রোহিঙ্গাদের উল্লেখ নেই।

আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) নামের একটি বিদ্রোহী গ্রুপ দুই মাস আগে কয়েকটি সীমান্ত চৌকিতে হামলা চালিয়ে বেশ কয়েকজন পুলিশকে হত্যার পর এবারের সঙ্কটের সূচনা হয়। হামলার পরপরই সামরিক বাহিনী পাল্টা অভিযান শুরু করে। তারা হামলাকারীদের ধাওয়া করে।

পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তারা অভিযোগ করেছে, মিয়ানমার সামরিক বাহিনী তাদেরকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, নিরাপত্তা অভিযানের সময় শত শত লোক নিহত হয়েছে। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের তীব্র নিন্দা জানিয়ে জাতিসংঘ একে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে অভিহিত করেছে।

রাখাইনে সামরিক অভিযানকালে তারা যেসব মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে, মিয়ানমার সরকার এবং সামরিক বাহিনী উভয়েই তা অস্বীকার করেছে। অতি সম্প্রতি কর্তৃপক্ষ অভিযোগ করেছে, বিদ্রোহীরা বেশ কয়েকজন গ্রামবাসীকে হত্যা ও অপহরণ করেছে। এসব লোক সরকারের দালাল বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। শত শত হিন্দু এবং জাতিগত মিয়ো জনগোষ্ঠীর সদস্যকে হত্যার জন্যও সরকার রোহিঙ্গা হামলাকারীদের দায়ী করছে।

প্রায় এক সপ্তাহ আগে অং সান সু চি উদ্বাস্তুদের সহায়তা প্রদান, তাদের প্রত্যাবর্তন তদারকি এবং তাদের পুনঃবসতি স্থাপনে সহায়তা করার জন্য সরকারের ব্যাপকভিত্তিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করার কথা ঘোষণা করেন। এটা হলো বেসামরিক-কেন্দ্রিক উদ্যোগ। সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠরা সাউথ এশিয়ান মনিটরকে এমনই জানিয়েছেন। তিনি এই উদ্যোগকে সমর্থন করার জন্য দেশবাসীর কাছে আবেদন জানিয়েছেন। মিয়ানমারের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, দেশের অনেক নামকরা ধনকুবের তার পক্ষে যোগ দিয়েছেন।

নিরপেক্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন দি ইউনিয়ন অব ফেডারেশন অব চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ইউএমএফসিসিআই) সহিংসতা-কবলিত রাখাইন রাজ্যের জন্য ১৩ মিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক  প্রকল্পের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ১০ দিন আগে ঘোষিত ‘ইউনিয়ন এন্টারপ্রাইজ ফর হিউমেনিটেরিয়ান অ্যাসিস্ট্যান্স, রিসেটেলমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ইন রাখাইন’ বাস্তবায়নে ভূমিকা পালনের জন্য ৯টি ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয়।

ওয়ার্কিং গ্রুপগুলো ৯টি প্রধান ক্ষেত্রে কাজ করবে। এগুলো হচ্ছে অর্থনৈতিক জোনের অবকাঠামো, গবাদি পশু ও মৎস্যের মতো জীবিকা-সংশ্লিষ্ট কর্মসূচি বাস্তবায়ন, অর্থ ও গণসংযোগ, চাকরি সৃষ্টি, কারিগরি শিক্ষা প্রদান, ক্ষুদ্র ঋণ, পর্যটন খাতের বিকাশ। রাজধানীতে স্টেট কাউন্সিলরের সাথে বৈঠকের পর ব্যবসায়ীরা এই কর্মসূচির কথা ঘোষণা করেন।

রাখাইন রাজ্যে সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও আস্থাহীনতা দূর করতে বেসামরিক উদ্যোগে সমাধান ছিল সু চি’র পরিকল্পনা। তিনি চেয়েছেন, পুরো জাতিকে এতে সামিল করতে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সেনাবাহিনীকে দেওয়া হয়েছে নিরাপত্তা প্রদানের দায়িত্ব। সামরিক কমান্ডাররা নয়, বেসামরিক লোকজনই রাখাইনের সমস্যার সমাধান করবে বলে চেয়েছেন সু চি।

অন্যদিকে আগস্টে অভিযান শুরুর পর থেকে স্থানীয় সামরিক কমান্ডাররা রাখাইনে জরুরি অবস্থা জারির জন্য চাপ দিয়ে আসছে। এমনটা করা হলে রাখাইনের পরিস্থিতি পুরোপুরি সামরিক বাহিনীর হাতে চলে যেত। সু চি এই দাবি প্রতিরোধ করে আসছেন বলে তার ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন।

তার অনুপস্থিতিতে সামরিক বাহিনী যাতে জরুরি আইন জারি করে ফেলতে না পারে, সেজন্য তিনি গত মাসে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যাননি। কারণ তার অনুপস্থিতিতে সামরিক বাহিনী থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত ভাইস প্রেসিডেন্ট মিন্ত সুয়ের পক্ষে কাজটি করা খুব সহজ হয়ে যেত। এদিকে প্রেসিডেন্ট হতিন কিয়ায়ো অসুস্থ হওয়ায় দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। তিনি এখন চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

একইসাথে তিনি জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিও প্রতিরোধ করে আসছেন। সামরিক বাহিনীকে তার পক্ষে রাখার জন্য এ কাজটি তিনি করেছেন। তিনি মনে করেন, কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করলে পরিণামে মিয়ানমারের গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

কিন্তু সামরিক বাহিনীর প্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হলাইংয়ের সাথে সু চির দূরত্ব বেড়ে যাওয়ায় তার পক্ষে পরিকল্পনা অনুযায়ী অগ্রসর হওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। সেনা কমান্ডারের ঘনিষ্ঠ এক সিনিয়র সাবেক সেনা কর্মকর্তা সাউথ এশিয়ান মনিটরকে বলেন, সামরিক বাহিনীর মধ্যে অং সান সুচির প্রতি অবিশ্বাস বাড়ছে। এটা কেবল মিন অং হলাইং এবং তার মধ্যে নয়, পুরো সেনাবাহিনীর মধ্যেই সু চি সম্পর্কে অবিশ্বাস বাড়ছে।

রাখাইন রাজ্যের ভয়াবহ পরিস্থিতির কারণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখন মিয়ানমারের ওপর, তার সামরিক বাহিনীর ওপর নতুন করে অবরোধ আরোপের কথা ভাবছে। ওই সাবেক সেনা কর্মকর্তা বলেন, সেনাবাহিনী এখন মনে করছে, সু চি হয়ে পড়েছেন অন্তর্ঘাতমূলক এজেন্ট। রাখাইনে সামরিক অভিযানের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সমালোচনা এবং অবরোধ আরোপের ক্রমবর্ধমান চাপকে বিবেচনা করা হচ্ছে ‘যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্র’ ষড়যন্ত্র হিসেবে। তারা মনে করছে, এসবের পেছনে কলকাঠি নাড়ছেন খোদ সু চি।

সেনাবাহিনীর মধ্যে ক্রমাগতভাবে এই ধারণার সৃষ্টি হচ্ছে যে, তারা অবরোধের মধ্যে আছে। এটা একটা অশুভ ঘটনা। তারা মনে করছে, সু চি তাদের আন্তর্জাতিক নিন্দা ও অবরোধ থেকে রক্ষা করতে পারবেন না। ফলে তারা মনে করতে পারে, প্রশাসনিক অভ্যুত্থান ছাড়া তাদের সামনে আর কোনো বিকল্প খোলা নেই। আর সামরিক বাহিনীর রচিত ২০০৮ সালের সংবিধানের আওতায় তা করা সম্ভব।

 

সূত্র:  south asian monitor

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন