সশস্ত্র উপজাতি গ্রুপের চাঁদাবাজি, মুক্তিপণে পাহাড় অশান্ত

বছরে সাড়ে চার শ’ কোটি টাকা, কেনা হচ্ছে আধুনিক অস্ত্র-গোলাবারুদ

চাঁদাবাজি

ফিরোজ মান্না, রাঙ্গামাটি থেকে ফিরে ॥

পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা প্রকাশ্যেই চাঁদাবাজি করছে। চাঁদা না দিলে করা হচ্ছে অপহরণ, নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যা, ধর্ষণ। চাঁদার হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না সরকারী-বেসরকারী চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী ও কৃষক। এমনকি মোবাইল অপারেটরদের প্রতিমাসে কোটি টাকা চাঁদা দিতে হচ্ছে। বিভিন্ন অফিস ও ব্যক্তিকে চাঁদার পরিমাণ নির্ধারণ করে চিঠি দেয়া হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ে জেএসএস, ইউপিডিএফ ও জেএসএস সংস্কারপন্থী গ্রুপের হাতে চাঁদার টাকা পৌঁছে দিতে হয়।

গত কয়েক মাস থেকে পাহাড়ে এমন এক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করার কারও সাহস নেই। যদি জানতে পারে কে অভিযোগ করেছে- তাহলে পরের দিন তার লাশ ফেলে দেয়া হচ্ছে। পাহাড় যেন ‘মগের মুল্লুকে’ পরিণত হয়েছে।

একটি গোয়েন্দা সূত্র জানায়, চাঁদা না দিলে পাহাড়ে কোন কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। সরকারের উন্নয়ন কাজ থেকেও চাঁদা দিতে হচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি যাই হোক না কেন নির্দিষ্ট হারে চাঁদা দিতে হয় তিন বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনকে। জনসংহতি সমিতি (জেএসএস-সন্ত লারমা গ্রুপ), জেএসএস সংস্কার পন্থী ও ইউনাইটেড পিপল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) নির্ধারিত চাঁদা দিতে অস্বীকার করলেই শুরু হয় অপহরণ, নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যা, ধর্ষণ। জ্বালিয়ে দেয়া হয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাড়ি-ঘর, যানবাহন।

চাঁদাবাজী

চাঁদার হাত থেকে রেহাই নেই সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও। বেতনের একটি অংশ চাঁদা হিসেবে দিতে হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় এমনই অবস্থা। বিচ্ছিন্নতাবাদীরা আবার চাঁদার রশিদও দিচ্ছে। অনেকটা প্রকাশ্যেই চাঁদাবাজি চলছে। এ মনকি পাহাড়ী নৃ-গোষ্ঠীর কাছ থেকেও চাঁদা নেয়া হয়। তবে বাঙালীদের চেয়ে তাদের চাঁদার রেট কিছুটা কম। প্রতিদিনই পার্বত্য অঞ্চল থেকে সশস্ত্র উপজাতি গ্রুপগুলো এক থেকে দেড় কোটি টাকার চাঁদা আদায় করছে।

আর বছর শেষে প্রতিটি গ্রুপই (জেএসএস-সন্তু, জেএসএস-সংস্কার ও ইউপিডিএফ) পার্বত্য অঞ্চল থেকে আদায় করছে সাড়ে চার শ’ কোটি টাকা। চাঁদা আদায়ে নিয়োজিত রয়েছে জেএসএস ও ইউপিডিএফের সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার সশস্ত্র প্রশিক্ষিত কর্মী। চাঁদার টাকায় কেনা হচ্ছে অত্যাধুনিক অস্ত্র গোলাবারুদ। চালানো হচ্ছে সংগঠনের অন্যান্য কার্যক্রম।বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, রেশন, অবসরকালীন ভাতা, ক্ষতিপূরণ বাবদ ব্যয় করা হচ্ছে। এছাড়া পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠনগুলো চাঁদার অর্থে দেশ-বিদেশে বাঙালীবিদ্বেষী প্রচার কাজেও ব্যবহার করছে।

অন্যমিডিয়া

পার্বত্য অঞ্চল ঘুরে লোকজন ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চাঁদাবাজি চলছে প্রকাশ্যেই। চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কেউ কোন কথা বলার সাহস রাখে না। ইতোপূর্বে দু’একজন চাঁদা দিতে অস্বীকার করায় তাদের হত্যা করা হয়েছে। এমনকি তাদের পরিবারের সদস্যদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করেছে। মেয়েদের তুলে নিয়ে ধর্ষণ করেছে। এ সবের হাত থেকে বাঁচতে নীরবে চাঁদা দিয়ে যাচ্ছে। কেউ প্রতিবাদ করছে না। চাঁদার বিষয়টি পুলিশ স্বীকার করেছে।

পুলিশ বলছে, কেউ যেহেতু অভিযোগ করে না। তাই কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়া যাচ্ছে না। বাঙালী ও উপজাতি সম্প্রদায়ের কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল, গাছের ফল, ক্ষেতের ফসল, ছোট-বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কৃষক-শ্রমিক-মৎস্যজীবী, সব ধরনের যানবাহন, সরকারী-বেসরকারী চাকরিজীবী, স্থানীয় উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত পরিবার, দেশী ও মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি, জমি কেনাবেচা, কাঠ-বাঁশ, মোবাইল অপারেটরসহ সবাইকেই চাঁদা দিতে হচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত থানায় এ নিয়ে কোন অভিযোগ দায়ের হয়নি।

গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিন পার্বত্য জেলায় দৈনিক দেড় কোটি টাকার চাঁদা তুলে উপজাতিদের সশস্ত্র গ্রুপগুলো। দিনে দিনে এই চাঁদার পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। সরকারের কাছে দেয়া ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, জেএসএস (সন্তু), জেএসএস (সংস্কার) ও ইউপিডিএফের সন্ত্রাসী কর্তৃক চাঁদাবাজি ও অপহরণের ঘটনা গত কয়েক মাসে চরম আকার ধারণ করেছে। এভাবে চলতে থাকলে পার্বত্য চট্টগ্রামে জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়বে। শান্তিচুক্তির বেশিরভাগ দফা বাস্তবায়ন হলেও নতুন করে জেএসএস স্বায়ত্তশাসন চেয়ে আন্দোলন শুরু করেছে। আর ইউপিডিএফ চাইছে পূর্ণ স্বাধীনতা। সংস্কারপন্থীরা কয়েকটি শর্তে মূলত স্বায়ত্তশাসন চাইছে।

সূত্র: দৈনিক জনকণ্ঠ।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন