বৈসুক-সাংগ্রাই-বিজু উৎসবে আনন্দে মেতে উঠেছে তিন পার্বত্য জেলার পাহাড়ি জনপদ
রাঙামাটি প্রতিনিধি।
বৈসুক-সাংগ্রাই-বিজু উৎসবের আনন্দে মেতে উঠেছে পাহাড়ি জনপদ। এই উৎসবকে ঘিরে পাহাড়ে তিন পার্বত্য জেলায় এখন বইছে অনাবিল আনন্দ। পুরনো বছরকে বিদায় দিয়ে নতুন বছরকে বরণে পাহাড় এখন হয়ে উঠেছে বর্ণিল ও বৈচিএ্যময়। জাতি,ধর্ম,বর্ণ,নির্বিশেষে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি বাঙালী সম্প্রদায়ও মেতে উঠেছে আনন্দে। তাই পাহাড়ে এই উৎসব হয়ে ওঠে সার্বজনীন। ভেদাভেদ,সংকীর্ণতা,হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে সকলে আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠার এ এক সুবর্ণ সুযোগ বৈকি। আদিবাসীরা মনের আনন্দে বাড়ি বাড়ি বেড়িয়েছেন।
গতকাল পাহাড়ী পরিবারগুলো পাচনসহ নানা উপাদেয় খাবার দিয়ে অতিথিদের আপ্যায়ন করেন। চৈত্র সংক্রান্তির দিনে স্বকীয় সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ও চেতনাকে ধারণ করে পুরনো বছরের গ্লানি মুছে আজ নববর্ষে মিলন,শান্তি ও মৈত্রীর এিবেণী বন্ধনে আবদ্ধ হবেন। গতকাল অনেকে ভবিষ্যত সুখ-শান্তি কামনা করে নতুন বছরে ভাল থাকার প্রার্থনা করেন। তিন দিনের উৎসবের শেষ দিনে আজ নববর্ষে চাকমা সম্প্রদায় গজ্যাপজ্যা,এিপুরা সম্প্রদায় বিসিকাতাল ও মারমা সম্প্রদায় সাংগ্রাইং আপ্যাইং বা পোজ্যাই নামে বছরের প্রথম দিন পালন করবে।
চাকমারা মূল বিজুর দিনে অনেক আনন্দ করে বিশেষ পানীয়সহ খাবার খেয়ে ক্লান্ত হওয়ায় আজ তারা গজ্যাপজ্যা বা গড়াগড়ি দিয়ে বিশ্রাম নেবেন। বিজুতে ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা,সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান,সামাজিক অনুষ্ঠানাদিসহ প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও সুস্বাদু খাবারের আনন্দের তৃপ্তি আলাদা। চাকমা সমাজে ছোটরা বড়দের প্রণাম করে আজ আশীর্বাদ নেবে। প্রত্যেকে উন্নতমানের খাবার খাবে। বিকালে বৌদ্ধ বিহারে গিয়ে ভবিষ্যত সুখ-শান্তির জন্য বিশেষ প্রার্থনা করবে। আজকের গজ্যাপজ্যা বিজুর মধ্য দিয়ে চাকমাদের প্রধান সামাজিক উৎসব বিজুর পরিসমাপ্তি ঘটবে।
এিপুরা সম্প্রদায় আজ পালন করবে বিসিকাতাল। নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে সৃষ্টিকর্তার কাছে শস্য সম্পদের জন্য প্রার্থনা এবং ফুল মেশানো কলসির পানি ঢেলে গুরুজনের আশীর্বাদ নেবে। সবাই মিলে মন্দিরে গিয়ে প্রার্থনা করবে। এিপুরাদের উৎসবের প্রধান আকর্ষণ হল গরাইয়া নৃত্য। জুমিয়া জীবন প্রতীক ধর্মী হিসেবে এই নৃত্যে ফুটে উঠে। নৃত্যটি এিপুরা পল্লীতে তিন থেকে সাত দিন পর্যন্ত চলে। যে বাড়ি থেকে নৃত্যটি শুরু হয় সেই বাড়ি গিয়ে নৃত্য শেষ হয়। নৃত্য শুরুর সময় একবার ও সমাপ্তির দিনে একবার মোট দু’বার গরয়া দেবতাকে পূজা করা হয়। শিবের ঘরনি গৌরি থেকে গরয়া নৃত্যের উদ্ভব হয়েছে বলে মনে করেন এিপুরারা। গরয়া প্রেমে আত্মহারা শিব গৌরি দেবীকে খুঁজতে মরিয়া হয়ে যে তান্ডব নৃত্য শৃুরু করে তা ওদের কাছে গরয়া নৃত্য হিসেবে পরিচিতি পায়। এই নৃত্যে শিবের অনুপস্থিতিতিতে এিশুলকে শিবের প্রতীক হিসেবে রাখা হয়। এ এিশুলকে কেন্দ্র করে ঢোল-বাঁশির তালে তালে একদল একসঙ্গে কুন্ডলাকারে নৃত্য পরিবেশন করে। বাড়ি বাড়ি ঘুরে পরিবেশিত গরয়া নৃত্যের মাধ্যমে তুলে ধরা হয় এিপুরাদের সামাজিক,সাংস্কৃতিক বিভিন্ন জীবন চিত্র। পূজার আশীর্বাদ নৃত্যের মাধ্যমে পৌঁছে দেয় প্রতিটি বাড়িতে। বিনিময়ে গৃহকর্তা হাঁস,মোরগ-মুরগী,ছাগল,শুকর,নগদ অর্থ ইত্যাদি দেয়। এসব দ্রব্য সংগ্রহের পর নৃত্যের দলপতি অচাই নববর্ষের দিনে নিজ গ্রামে ফিরে পূজা দিয়ে নৃত্যের সমাপ্তি করেন।
মারমা সম্প্রদায় নতুন বছরের প্রথম দিনকে সাংগ্রাই আপ্যাইং বলে। ওদের অনেকে ভোরে উপাসনা করে ও পিন্ড দান করে। বছরের প্রথম দিন তারা পানি খেলার আয়োজন করে। এই আয়োজন বিভিন্নস্থানে কয়েকদিন চলে। তারা পুরাতন বছরের দুঃখ-কষ্ট,হতাশা মুছে ফেলার জন্য পানি ছিটায়। একদল তরুণ ও তরুণী গানের তালে তালে পরস্পরের মধ্যে পানি ছুঁড়ে মারে। মারমা যুবক-যুবতীরা যখন সুন্দর পোশাকে সেজে পানি খেলায় মেতে উঠে তখন চারদিকে আনন্দ,উচ্ছ্বাস ও উল্লাস মুখরিত হয়ে উঠে। সেই আনন্দ তখন ছড়িয়ে পড়ে সবার মাঝে। পানি খেলা ছাড়াও মারমারা বিভিন্ন খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠে।###