প্রথম আলোর রিপোর্ট প্রসঙ্গে পাঠকের প্রতিক্রিয়া
পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে ব্যক্তিগত আগ্রহ থেকে সৃষ্ট স্বল্প জ্ঞানের আলোকে মনে হয়েছে, প্রথম আলোর এই উদ্যোগের আরো অনেক বেশি প্রশংসা অর্জনের সুযোগ ছিল। শুধু তাই নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের চলমান সমস্যার আরো কয়েকটি দিকের উপর আলোকপাত করতে পারলে এবং বর্ণিত তথ্যাবলীর পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট তবে ভিন্নধর্মী সূত্রের মতামত এবং তথ্য ব্যবহার করলে এই প্রতিবেদনের গ্রহণযোগ্যতা নিঃসন্দেহে আরো বৃদ্ধি পেতে পারতো।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানে যে কোনো ধরনের উদ্যোগ নিয়ে কাউকে এগিয়ে আসতে দেখলে অনুপ্রাণিত বোধ করি। দৈনিক প্রথম আলোর ১৫মে ২০১৯ তারিখে প্রকাশিত, ‘চুক্তিতেই আটকে আছে পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি তেমনি এক উদ্যোগ বলেই মনে হয়েছে আমার কাছে। প্রতিবেদনের তথ্য-উপাত্ত দেখে বুঝতে বাকী নেই যে, প্রতিবেদক যথেষ্ট পরিশ্রম করেছেন।
প্রথম আলোর প্রতিবেদনটি ভালো লেগেছে কয়েকটি কারণে। তন্মধ্যে অন্যতম হলো, পার্বত্য চট্টগ্রামের চলমান বেশ কিছু সমস্যা পাঠকের সামনে তুলে ধরার ইতিবাচক প্রচেষ্টা। এছাড়া, ব্যবহৃত শব্দাবলী এবং প্রকাশিত মতামতে সরাসরি কারো অনুভূতিকে আঘাত না দেওয়ার একটা প্রশংসনীয় প্রচেষ্টাও লক্ষ্যণীয়। আমি নিশ্চিত, দেশের অনেক সচেতন এবং শান্তিকামী নাগরিক এ ধরনের উদ্যোগকে সর্বদাই স্বাগত জানিয়েছেন। বলাই বাহুল্য, সঙ্গত কারণেই প্রথম আলো কর্তৃপক্ষকে সাধুবাদ এবং ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে ব্যক্তিগত আগ্রহ থেকে সৃষ্ট স্বল্প জ্ঞানের আলোকে মনে হয়েছে, প্রথম আলোর এই উদ্যোগের আরো অনেক বেশি প্রশংসা অর্জনের সুযোগ ছিল। শুধু তাই নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের চলমান সমস্যার আরো কয়েকটি দিকের উপর আলোকপাত করতে পারলে এবং বর্ণিত তথ্যাবলীর পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট তবে ভিন্নধর্মী সূত্রের মতামত এবং তথ্য ব্যবহার করলে এই প্রতিবেদনের গ্রহণযোগ্যতা নিঃসন্দেহে আরো বৃদ্ধি পেতে পারতো।
বস্তুতঃ প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয়াবলীর আলোকেই এহেন অনুকল্প বা পূর্বানুমানের অবতারণা; যে বিষয়গুলো পাঠকের বিবেচনার জন্যে তুলে ধরা যেতে পারে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের হত্যাকাণ্ডের উপর আলোকপাত করতে গিয়ে, গত বছরের ৩মে ২০১৮ তারিখে রাঙ্গামাটির নানিয়ারচরের উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমাকে হত্যার ঘটনা দিয়ে শুরু করে চলতি বছরের ৮ মে তারিখে বান্দরবানে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও ৪মে ২০১৮ তারিখে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া এক বাঙালিসহ ৫ জনের পাশাপাশি ১৮আগস্ট ২০১৮ তারিখে খাগড়াছড়ি শহরে ৬জন পাহাড়িকে হত্যার ঘটনাও উল্লেখ করা হয়েছে।
ফলে স্বাভাবিকভাবেই, চলতি বছরের ১৮ মার্চ তারিখে বাঘাইছড়িতে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের বহনকারী গাড়ীতে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের বেপরোয়া গুলিবর্ষণে ৮ জন নিহত এবং ২৯ জন আহত হওয়ার এত বড় ঘটনা উল্লেখ না করাটাই বিষ্ময়ের উদ্রেক করে। আহত-নিহতদের পরিসংখ্যান এবং প্রতিবেদনে উল্লেখিত ঘটনাবলীর সময় সীমার প্রেক্ষাপটে এই ঘটনা উল্লেখ করাটাই বরং সর্বতোভাবে প্রত্যাশিত ছিল।
পার্বত্য চুক্তির পরে এত বড় সশস্ত্র হামলা ইতিপূর্বে আর ঘটেছিল কিনা জানা নেই- তাও আবার নিরাপত্তা বাহিনীর প্রহরাধীন গাড়ীতে সরকারী কর্মকর্তা- কর্মচারীদের উপর। এছাড়া এমনটি হওয়ার সুযোগ নিতান্তই সীমিত যে, একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডসমূহের তথ্যানুসন্ধানের সময় এই ঘটনা উঠে আসেনি। আবার এমন ধারণা পোষণ করা যুক্তিসংগত হতে পারে না যে- প্রতিবেদক এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন।
স্মরণযোগ্য, এই হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষিতে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে ঘটনার প্রায় এক মাস পরে প্রথম আলোর ১৭এপ্রিল ২০১৯ তারিখে প্রকাশিত ‘হামলার জন্যে জে এস এস প্রার্থীকে দায়ী’ শীর্ষক এক সংবাদ থেকে জানা যায় যে, তদন্ত কমিটি চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের নিকট তাদের প্রতিবেদন দাখিল করেছে। প্রথম আলোর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে,
“হামলার জন্যে নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) বড় ঋষি চাকমার সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের দায়ী করা হয়েছে।”
দেশের সাধারণ জনগোষ্ঠী অতটা না জানলেও, পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে যারা কিছুটা জ্ঞান রাখেন তারা সবাই ভালোভাবেই জানেন যে, পার্বত্যাঞ্চলে অস্ত্রধারীদের দৌরাত্ন এবং চাঁদাবাজির ব্যাপকতা কোন উচ্চতায় আসীন হয়েছে। তাদের কারোরই অজানা থাকার কথা নয় যে, বাঙালি– অবাঙালি নির্বিশেষে কী পরিমাণ সাধারণ মানুষ এই নরক যন্ত্রণায় প্রতিনিয়ত কাতরাচ্ছে। চাঁদাবাজির জন্য বিভিন্ন এলাকা নিয়ন্ত্রণে রাখতে অস্ত্রধারী সশস্ত্র সংগঠনের বিকল্প নেই বিধায়, পাহাড়ের সবগুলো আঞ্চলিক দলেরই নিজস্ব সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী রয়েছে। প্রতিবেদনে বর্ণিত ‘ভ্রাতৃঘাতী’ হত্যাকাণ্ডেরও অন্যতম নিয়ামক অস্ত্রধারীদের এই চাঁদাবাজি।
পুরো প্রতিবেদনেই তথ্যসুত্রের ভিন্নধারা এবং বহুমুখী তথ্যে ব্যবহারের সুযোগ অনুভূত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, কাপেং ফাউন্ডেশনের উদ্ধৃতি দিয়ে নিরাপত্তা বাহিনী এবং বাঙালীদের হাতে নিহত, আটক, নির্যাতন বা হুমকি-হামলার তথ্য উপস্থাপন করা হলেও, একই সূত্র কিংবা অন্য কোনো সূত্রের বরাতে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত, আটক, নির্যাতন বা হুমকি-হামলার শিকার হওয়া বাঙালীদের পরিসংখ্যান দেওয়া হয়নি। এতে করে, কারো কারো মনে এই পরিসংখ্যান একপেশে মনে হতে পারে।
আবার এই পরিসংখ্যানকে সঠিক হিসেবে মেনে নিলে, অর্ধসত্য হতে বঞ্চিত হতে হবে। কারণ, কাপেং ফাউন্ডেশনের বর্ণিত পরিসংখ্যানে পাহাড়ে কোনো বাঙালির নিহত, আটক, নির্যাতন বা হুমকি-হামলার শিকার হওয়ার ব্যাপারে কোন তথ্য নেই। অথচ কে না জানে যে, পাহাড়িদের হাতে নির্যাতন বা হত্যাকাণ্ডের শিকার বাঙালির সংখ্যা একেবারে কম নয়।
উপরন্তু, যে ভাষায় কাপেং ফাউন্ডেশনের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে, তাতে অনেক পাঠকের মনে এমন ভ্রান্ত ধারণার উদ্রেক হতে পারে যে, নিরাপত্তা বাহিনী নিরাপরাধ পাহাড়িদের আটক করছে। অথচ, প্রতিবেদনেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, গতবছর “পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানীয় আঞ্চলিক দলগুলোর সংঘাতে নিহত হয় অন্তত ৪৭ জন”, যেখানে দেশের অন্য সকল জেলায় নিহতের সংখ্যা ৬৭ জন।
কাপেং ফাউন্ডেশনের উল্লেখিত আটকের সংখ্যার মধ্যে বর্ণিত হত্যাযজ্ঞের গ্রেফতারকৃত আসামিদের সংখ্যা সামিল থাকা স্বাভাবিক। সুতরাং, নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে আটককৃতদের মধ্যে নিরাপরাধ অথবা আটককৃত অপরাধীর সংখ্যা উল্লেখ করলে পাঠকদের মনে কোন ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টির সম্ভাবনা বহুলাংশে কমে যেত।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, অস্ত্রধারী ও চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম কমাতে এবং অস্ত্রধারী পাহাড়িদের ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষ নিরসনে নিরাপত্তা বাহিনীর প্রচেষ্টা উল্লেখ করা যুক্তিসংগত ছিল। শুধু তাই নয়, গত বছর নিরাপত্তা বাহিনী কি পরিমাণ অস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে, সেটা উল্লেখ করাও যুক্তিসংগত ছিল। অথচ, প্রতিবেদক শুধুমাত্র একটি সূত্রের বরাতে আটকের তথ্য উল্লেখ করেছেন; নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক অস্ত্র উদ্ধার কিংবা অস্ত্রধারী/অপরাধী আটকের কথা নয়।
প্রথম আলোর প্রতিবেদনটি পড়ে, পাহাড়ির হাতে বাঙালির নির্যাতনের তথ্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে নির্ভরযোগ্য সুত্রের তথ্য হতে জানা যায় যে, ২০১৮ সালে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের হাতে ১৬ জন বাঙালি নিহত, ৬৫ জন বাঙালি আহত এবং ৩৮ জন বাঙালি অপহৃত হয়েছিল। সেই সাথে ২০১৬– ২০১৮ সালে কি পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছিল, অনুসন্ধানে নির্ভরযোগ্য সূত্র হতে তারও একটি পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে, যা নিম্নরূপঃ
প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করে সন্তু লারমা সেনাবাহিনীর ক্যাম্প প্রত্যাহার এবং চলতি অপারেশন ‘উত্তরণ’ বন্ধের দাবী জানিয়েছেন– প্রতিবেদনে এমন তথ্য দিতে পারলেও; চুক্তি স্বাক্ষরের পরেও জেএসএস অস্ত্রধারীদের পালন করছে– এত বড় সত্যিটা কোথাও উঠে আসেনি। যদিও বাস্তবে অস্ত্রধারীদের উপস্থিতি এবং তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা চুক্তির শর্তের অন্যতম বরখেলাপ।
চুক্তি বাস্তবায়নের যে দাবিগুলো সব সময় আঞ্চলিক দলগুলোর কণ্ঠে শোনা যায়, যেমনঃ ভূমি সমস্যা, আঞ্চলিক পরিষদের কার্যকারিতা, স্থানীয় পুলিশ বাহিনী গঠন, বাঙালি পুনর্বাসন ইত্যাদি নিয়ে বিভিন্ন বিজ্ঞজনের মতামত তুলে ধরলেও পাহাড়িদের তরফ হতে চুক্তির শর্ত ভেঙ্গে অস্ত্র হাতে রেখে দেওয়া এবং ক্রমান্বয়ে অস্ত্রধারীদের সংখ্যা বৃদ্ধির ব্যাপারেও কোন উৎকণ্ঠা প্রকাশ করা হয়নি। এমতাবস্থায়, কৌতূহল রয়েই যায় যে, সমাজের সকল ঘরানার বিজ্ঞজনের মতামত নেওয়ার সুযোগ কতটা সীমিত হলে এমনটি ঘটতে পারে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাসমূহ আলোচনার প্রেক্ষিতে স্বাভাবিকভাবেই ভূমি সমস্যার কথা উঠে এসেছে। তবে, কিছুটা হলেও প্রচ্ছন্ন দোষারোপের ইঙ্গিত অনুভুত হয়; যখন বলা হয়, “এই কমিশন গঠনের প্রক্রিয়ায় এবং বিতর্কে প্রায় দুই দশক চলে গেছে।”
অথচ, এই সময়ক্ষেপণের পিছনে পাহাড়ি নেতৃবৃন্দের একাংশের ভূমিকা ছিল প্রচণ্ড রকমের বেশি। এমনকি ভূমি জরিপ করার সরকারী উদ্যোগ ভেস্তে গিয়েছিল, এই পাহাড়ি নেতাদের একাংশের বিরোধিতার কারণেই। সঙ্গত কারণেই ভূমি সমস্যা সমাধানে সরকারের আন্তরিকতা এবং প্রচেস্টাসমূহ ইতিবাচকভাবে তুলে ধরা প্রত্যাশিত ছিল।
গবেষক এবং বিশেষজ্ঞদের মতামতে যথার্থই উঠে এসেছে যে, “চুক্তির ২১ বছর পরও পাহাড়ে শান্তি ও আস্থা ফেরেনি।” এই বাস্তবতার পিছনে যে সকল কারণ রয়েছে তাঁর মধ্যে অন্যতম হল, পাহাড়ে বাঙালি বিদ্বেষী অপপ্রচার; যা অনেক সময় মুসলিম বিদ্বেষী ঘৃণা প্রচার, এমনকি বাংলাদেশ বিরোধী অপপ্রচারেও রূপান্তরিত হতে দেখা গেছে।
পাহাড়িদের আর্থ সামাজিক চিত্র যেমনি হোক না কেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত বিষয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণ মূলত পাহাড়িদের অথবা তাদের সমমনাদের হাতে। এছাড়াও শিক্ষা ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালীদের তুলনায় পাহাড়িদের অবস্থান তুলনামূলকভাবে ভালো। ২০১১ সালের শুমারি অনুযায়ী, পার্বত্য অঞ্চলের উপজাতিদের গড় শিক্ষার হার ৪৪.৬২%, আর বাঙালিদের গড় শিক্ষার হার ২৩%। অথচ, বিভিন্ন গবেষকের সুত্রে উল্লেখ করা হয়েছে যে, চাকমা সম্প্রদায়ের শিক্ষার হার ৭৩% এর অধিক।
কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ পরবর্তী রাজনৈতিক সচেতনতাকে উপজীব্য করে পাহাড়িরা বাংলাদেশের ভিতরে ও বাইরে কিছু বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠীর সমর্থন ও সহানুভূতি আদায়ে সক্ষম হয়েছে। ফলে, তাদের অপপ্রচার এবং বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টার মধ্যে সত্যের ঘাটতি যেমনি থাকুক না কেন, এর বিপরীতে প্রতিবাদের স্বর কিংবা সত্য উচ্চারণে কণ্ঠের আওয়াজ প্রায়শই চাপা পরে থাকে।
ফলশ্রুতিতে, সরকারের বহুবিধ প্রচেষ্টার পরেও পাহাড়ী ও বাঙালিদের মধ্যে প্রত্যাশিত আস্থা গড়ে উঠতে পারেনি। বরং অনেক ক্ষেত্রেই চলমান ঘটনাবলীর গতি প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার পাহাড়ি ও বাঙালীদের মধ্যে আস্থা গড়া ওঠার অন্তরায় হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
উপরোন্তু, স্বাধীনতার অব্যবহিত পর পরই আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের দাবী আদায়ের জন্যে পাহাড়িরা হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে যে অবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে, পরবর্তী সময়ের বিভিন্ন কার্যকলাপে সেই অবিশ্বাস দূর হতে পারেনি। বরং হালের তথাকথিত ‘আদিবাসী ইস্যু’, চুক্তি পক্ষীয় দলের সশস্ত্র উপদল পালন করা এবং সাম্প্রতিক সোশ্যাল মিডিয়া ভিত্তিক বাঙালি বিদ্বেষী ও বাংলাদেশ বিরোধী অপপ্রচারের কল্যাণে সন্দেহ এবং অবিশ্বাসের আবরণ দূর হওয়ার তেমন কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
প্রতিবেদনে উন্নয়নের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে এভাবে যে, “সব ধরনের উন্নয়ন নির্দেশকের নিরিখে পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা এবং ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের একটি”। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড এবং বাজেট বরাদ্দের খুব সংক্ষিপ্ত হলেও একটা উল্লেখ থাকলে প্রকৃত বাস্তবতা ফুটে উঠত। কারণ, বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে থেকেই এই অঞ্চল অত্যন্ত পিছিয়ে ছিল। এতটাই পিছিয়ে ছিল যে, এম এন লারমা ২৩ জুন ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদে বলেছিলেন,
“ যে অঞ্চল থেকে আমি এসেছি, সে অঞ্চল বাংলাদেশের একটা পিছিয়ে পড়া অঞ্চল। আপনারা বিশ্বাস করতে পারবেন না যে, আমাদের ওখানে এখনও আদিম যুগের মানুষ রয়েছে। …….. আপনারা বিশ্বাস করবেন না, এরা অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় এখনও বাস করে। …… মাননীয় স্পীকার সাহেব, ব্রিটিশের সময়ে এবং পাকিস্তানের আমলে আমাদেরকে চিড়িয়াখানার জীবের মতো করে রাখা হয়েছিল।“
( জিবলু রহমান, (২০১৮), পার্বত্য চট্টগ্রাম-সমস্যা ও সমাধান (১৯৭২-১৯৯৮), শ্রীহট্ট প্রকাশ, পৃ-১৪২)।
পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার ব্যাপক প্রচেষ্টার কল্যাণে আজ এই অঞ্চলের পরিস্থিতি বর্তমান পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। সরকারের আন্তরিকতা না থাকলে এই অঞ্চল আরো পিছিয়ে থাকতো, নিঃসন্দেহে।শুধুমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যার দিকে তাকালেই পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে সরকারের প্রচেষ্টার প্রমাণ পাওয়া যাবেঃ
- কিন্ডারগার্টেন – ১২৩ টি।
প্রাইমারী স্কুল – ১৯০৭ টি।
হাই স্কুল – ২৯৯টি।
মাদ্রাসা – ১৯৬টি।
কলেজ – ২৮টি।
ডিগ্রী কলেজ – ১৯টি।
পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট – ১৩টি।
নার্সিং ইন্সটিটিউট – ২ টি।
মেডিকেল কলেজ – ১ টি।
বিশ্ববিদ্যালয় – ২ টি।
পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট জনসংখ্যা ১৬ লাখ ধরে হিসেব করলে বাংলাদেশের প্রায় ০.৫ % জনগোষ্ঠীর জন্যে ৩.০২% প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ২.০১% উচ্চ বিদ্যালয় হতে শুরু করে ২.৭৭%মেডিকেল কলেজ এবং ৪.৪৪%পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
ব্রিটিশ আমলে যেখানে কোনো পাকা সড়ক ছিল না, সেই পার্বত্য চট্টগ্রামে পাকিস্তান আমলে ৪৮ কিলোমিটার পাকা রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছিল। অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকার ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১৫৩৫ কিলোমিটার পাকা রাস্তাসহ অসংখ্য ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণ করেছে।
পাকিস্তান আমলে রাঙামাটিতে ৩১ শয্যার একটি মাত্র হাসপাতাল ছিল। এখন এর শুধু শয্যা সংখ্যা বাড়িয়ে ২৫০ করা হয়েছে তাই নয়, বরং প্রতিটি জেলায় এবং উপজেলা পর্যায়ে হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে, শুধু রাঙামাটি জেলাতেই এখন ১১টি সরকারী হাসপাতালে মোট ৭৫০টি শয্যা রয়েছে। খাগড়াছড়ি জেলা সদরের ১০০ শয্যার হাসপাতাল ছাড়াও সব উপজেলা সদরের হাসপাতাল মিলিয়ে মোট শয্যা সংখ্যা ৬৪০ টি।
একইভাবে বান্দরবান সদরের ১০০ শয্যার হাসপাতালের পাশাপাশি উপজেলা সদর সমূহের হাসপাতাল গোনায় ধরলে শয্যা সংখ্যা ৩৬৮ উপরে। অর্থাৎ পাকিস্তান আমলের ৩১ শয্যার একটি হাসপাতালের পরিবর্তে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন শুধুমাত্র সরকারি হাসপাতাল রয়েছে ২৮ টি, যেখানে ১৩৬০ টি শয্যা রয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্যে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত উন্নয়নমূলক পদক্ষেপের দীর্ঘ তালিকার পাশাপাশি এটাও সত্য যে বাঙালিরা এখানে তুলনামুলকভাবে অনেক পিছিয়ে আছে। তারা ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংক লোন, শিক্ষা ও চাকুরিতে অগ্রাধিকার ইত্যাদি বহুক্ষেত্রে পাহাড়িদের তুলনায় অনেক কম সুযোগ সুবিধা পায়। তাই প্রতিবেদনের উল্লেখিত বক্তব্যকে পাহাড়িদের জন্য যতটা না প্রযোজ্য, পার্বত্য অঞ্চলের বাঙালীদের জন্যেই বরং তাঁর চেয়ে বেশি প্রযোজ্য বলে প্রতীয়মান হয়।
পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের বৈচিত্র এবং স্বাতন্ত্র রক্ষা করাকে রাষ্ট্রের দায়িত্ব বলেই মনে করি। একই সাথে, রাস্ট্রকে এই দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করা প্রত্যেক সচেতন নাগরিকের কর্তব্য বলেই বিশ্বাস করতে চাই।
সেই বিবেচনায়, প্রতিবেদকের কণ্ঠে সুর মিলিয়ে আমিও বলতে চাই যে, পরিবেশের সুরক্ষা এবং সার্বিকভাবে পাহাড়ের মানুষের উন্নয়নের জন্য চুক্তির বাস্তবায়ন গুরুত্বপূর্ণ। তবে খেয়াল করা জরুরী যে, কোনো চুক্তি বাস্তবায়নে সময় প্রয়োজন হয়। তেমনি, সকল পক্ষের সদিচ্ছাও অপরিহার্য। পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষেত্রে সকল পক্ষ সমান আন্তরিক না হলে, সময় নষ্ট হবে, কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাবে না।
চুক্তির ২১ বছর পরে গভীরভাবে ভেবে দেখা যেতেই পারে যে, চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিকতার ঘাটতির দায় শুধু সরকারের উপর বর্তায় কিনা। যদি না বর্তায়, তাহলে, শুধুমাত্র সরকারের দায় চাপিয়ে কিংবা অন্যদের উপর দায় না চাপিয়ে আদৌ শান্তি কামনা করা বাস্তবসম্মত হবে না। সেই সাথে মনে রাখতে হবে যে, প্রকৃত বাস্তবতা উপস্থাপন করার মাধ্যমেও শান্তি অর্জনের এই প্রক্রিয়ায় সচেতন নাগরিকের ভূমিকা পালনের সুযোগের সদ্ব্যবহার সম্ভব।
♦ মাহের ইসলাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক।
মাহের ইসলামে আরো লেখা পড়ুন
- পার্বত্য চট্টগ্রামে অপপ্রচার: মুদ্রার অন্য দিক
- মারমা দুই বোন, অপপ্রচার এবং ডিজিটাল যুগের দুর্বলতা
- পাহাড়িদের সরলতা কি গুটিকয়েকজনের ক্রীড়নক: প্রেক্ষিত বিলাইছড়ি ইস্যু
- পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীঃ নির্দোষ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত দোষী
- মিথুন চাকমার প্রতি সহানুভুতি কি অবিচার ?
- দেশের সার্বভৌমত্ব, জাতীয় চেতনা ও নাগরিক নিরাপত্তা নিয়ে অপপ্রচার বন্ধে কোনো ছাড় নয়
- ইমতিয়াজ মাহমুদ- মিথ্যা বিভ্রান্তি ছড়িয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি না করে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শেখান(ভিডিও)
- অপহরণের প্রতিবাদ: মানবিক, বাণিজ্যিক, না রাজনৈতিক?
- রোহিঙ্গা নিধনে ফেসবুকের অপব্যবহার এবং পার্বত্যাঞ্চলে বাঙ্গালী বিদ্বেষী অপপ্রচার
- পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের ব্যক্তি স্বার্থের কাছে জিম্মি সমাজ ও রাষ্ট্র
- ব্যাক্তিগত বিশ্বাস, সংবাদ মাধ্যম ও নৈতিকতার মানদণ্ড
- কাপ্তাই বাঁধ প্রকল্পের ক্ষতিপূরণঃ ব্যক্তি স্বার্থের রাজনীতির শিকার নিরীহ পাহাড়ি
- ভূষণছড়াঃ যেখানে শুধু কুকুরই বেঁচে ছিল!
- প্রেক্ষাপট বিচারে কল্পনা চাকমার ’অপহরণ’ যাচাই
- কল্পনা চাকমা অপহরণ না অন্তর্ধান
- দোষী না নির্দোষ?
- পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী ও বাঙালী কেন এলো?
- মিথ্যে অপবাদের দায়মুক্তি!
- নতুন কৌশলে পাহাড়ীদের ভূমি দখল: পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বাঙালী বিতাড়নের নীল নকশা
- মুক্তিযুদ্ধে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ভূমিকা
- ধর্মীয় স্থাপনা নির্মাণ পার্বত্য চট্টগ্রামে অবৈধ ভূমি দখলের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে
- মিতালী চাকমা ধর্ষণ ও সুশীল সমাজ এবং নারী নেত্রীদের দ্বিচারিতা
- পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়নের অগ্রগতিঃ প্রচারণা ও বাস্তবতা
- ‘তোরা বাঙালি হইয়া যা’- সত্য মিথ্যা মিথ: ইতিহাস বিচার-পর্ব-১
- তোরা বাঙালি হইয়া যা- সত্য মিথ্যা মিথ: ইতিহাস বিচার- ২
- পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও অবদান
- বাহাত্তরের ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গবন্ধুর সাথে পাহাড়ী প্রতিনিধিদলের বৈঠক হয়েছিল কি?
- এ মৃত্যুর শেষ কোথায়?
- মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার দ্বৈত ভূমিকা