মিয়ানমারের এককালের পদাতিক সেনা এখন গণ-নির্যাতনের সম্ভাব্য বড় সাক্ষী

fec-image

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ছেড়ে আসা কথিত দুজন ব্যক্তি ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ড ও ধর্ষণে অংশ নেয়ার তথ্য প্রকাশের পর হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) তাদেরকে হেফাজতে নিয়েছে।

নেদারল্যান্ডসে তাদের আসার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে সিবিসি নিউজ। রোহিঙ্গাদের ন্যায়বিচারের পথে এই ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ বাঁক বদল ঘটাতে পারে।

একটি সূত্র সিবিসিকে বলেছে, তারা যে তথ্য নিয়ে এসেছে, সেটা আদালতের তদন্তকে অনেকখানি এগিয়ে নেবে।

মিয়ানামরের ভেতরে শুরুতে তারা যে বিবৃতি দিয়েছিল, সেটা ভয়াবহ। ৩৩ ও ৩০ বছর বয়সী এই দুই ব্যক্তি নিধনযজ্ঞে অংশ নেয়া ব্যাটালিয়নের নাম, ধ্বংস করা গ্রামের নাম, এবং এমনকি গণকবরের অবস্থান পর্যন্ত জানিয়েছে, যেগুলো খুঁড়ে নিহতদের মৃতদেহ সেখানে চাপা দেয়ার ব্যাপারে তারা অংশ নিয়েছিল।

এটাই প্রথম ঘটনা যেখানে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর দায়িত্ব পালনকারী সদস্যরা সহিংসতার ভেতরের খবর জানালো। এর আগের বিবরণগুলো এসেছিল ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে।

২০১৭ সালে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তারা গণহত্যা, যৌন নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর অভিযোগ করে।

কানাডাসহ বেশ কিছু দেশ এই নিধন অভিযানকে গণহত্যা আখ্যা দিয়েছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুসন্ধানী মিশন তথ্য প্রমাণ পেয়েছে এবং সামরিক বাহিনীর অন্তত ছয়জন শীর্ষ কর্মকর্তাকে বিচারের মুখোমুখি করার সুপারিশ করেছে তারা।

হেগে যে দুজন বিবরণ দিয়েছেন, তারা নিম্ন পদের সৈনিক এবং বিভিন্ন কর্মকর্তাদের দেয়া আদেশের কথা জানিয়েছেন তারা, যারা তাদেরকে ‘সব’ রোহিঙ্গাদের গুলি করে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিল, এবং এদের মধ্যে নারী, শিশু ও বয়স্ক সবাই ছিল। এই তথ্যগুলো মামলার ভিত্তিকে আরও মজবুত করবে।

আলাদা তবে একই ধরনের ভিডিও

মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী বা তাতমাদাও বলে এসেছে যে, গেরিলাদের বিরুদ্ধে ‘শুদ্ধি অভিযান’ চালানো হয়েছিল, এবং কোন বর্বরতা হয়ে থাকলে, সেগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিন্তু এই দুজনের স্বীকারোক্তি ভিন্ন ইঙ্গিত দিচ্ছে।

সূত্র নিশ্চিত করেছে যে, এই দুই ব্যক্তি এখন হেগে রয়েছেন। প্রথমে তারা আলাদাভাবে একই ধরনের ভিডিও প্রকাশ করেন, যেখানে তারা নিজেদেরসহ অন্তত ১৭ জনের নাম উল্লেখ করেন, যারা ২০১৭ সালের ওই বর্বর নিধনযজ্ঞে অংশ নিয়েছিল।

এই ভিডিও দুটি তৈরি করেছে আরাকান আর্মি, যাদের সাথে যুদ্ধ করছে তাতমাদাও। ভিডিওতে গ্রুপটির লোগো এবং ইংরেজি সাবটাইটেল সংযু্ক্ত রয়েছে।

দুই ব্যক্তিকে নিয়ে আলাদা ভিডিও তৈরি করা হয়েছে। সেখনে তারা সহিংসতায় অংশ নেয়ার কথা বলেছে। ভিডিওতে তারা নিজেদেরকে লাইট ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন নং ৫৬৫ এর প্রাইভেট মাইও উইন তুন এবং ৩৫৩ নং লাইট পদাতিক ব্যাটালিয়নের প্রাইভেট জাউ নাইং তুন হিসেবে পরিচয় দেয়।

আগে সংগৃহীত তথ্যের সাথে তুলনা করে ফোর্টিফাই রাইটস জানিয়েছে যে, ভিডিওতে তাদের দেয়া তথ্য বিশ্বাসযোগ্য।

প্রধান নির্বাহী ম্যাথিউ স্মিথ বলেছেন, “তাদের বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে”। হেগে যারা হেফাজতে আছেন, ভিডিওতে তারাই কথা বলেছেন।

এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, “আগে আমরা যে তথ্য সংগ্রহ করেছিলাম, এবং এখন সেনারা যে সব তথ্য দিচ্ছে, সেগুলো আমরা ভালোভাবে মিলিয়ে দেখেছি”।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দুজনের একজন জানিয়েছে যে, কিয়েত ইয়ো পাইন গ্রামে সে পাহারার কাজ করেছে, যখন তার চেয়ে উঁচু পদের সেনারা যৌন নির্যাতন চালিয়েছে।

স্মিথ বলেন, ফোর্টিফাই রাইটস কিয়েত ইয়ো পাইন গ্রামের ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে প্রচুর অভিযোগ পেয়েছেন যে, গ্রামের একটা অংশ ‘ব্যাপক মাত্রায় বর্বর’ যৌন নির্যাতন চালানো হয়েছে। তারা যে সময়ের কথা বলেছিল, আটক ব্যক্তি তার ব্যাটালিয়নের সাথে সেই সময় সেখানে ছিল বলে জানিয়েছে।

স্মিথ বলেন, তাছাড়া যেখানে গণকবর রয়েছে বলে তারা জানিয়েছে, সেখানে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ হয়েছে বলে আগেই প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল।

সাক্ষ্য ‘গুরুত্বপূর্ণ’ হতে পারে

স্মিথ বলেছেন, তারা ছয়টি হালকা পদাতিক ব্যাটালিয়নের নাম বলেছে, যারা ওই এলাকাতে আগেও কাজ করেছে। সব মিলিয়ে এই দুজন প্রায় ১৮০ জনকে হত্যার সাথে জড়িত। এদের একজন যৌন নির্যাতনে জড়িত থাকার কথাও স্বীকার করেছে।

এই সেনারা সকাল বেলা অভিযান চালানোর এবং পুলিশের জড়িত থাকার যে সব তথ্য দিয়েছে, ভুক্তভোগীদের বর্ণনার সাথে তা পুরোপুরি মিলে যায়।

স্মিথ বলেন, এমন কোন প্রমাণ মেলেনি যে, কোন হুমকির মুখে তারা বক্তব্য দিয়েছেন।

স্মিথ বলেন, “হেগের দুজন যদি একই ব্যক্তি হন, তাহলে তাদের স্বীকারোক্তি হবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ”। রোহিঙ্গাদের জন্য সেটা হবে ‘অনেক বড় বিষয়’।

তিনি বলেন, তেমনটা হলে আইসিসির উচিত হবে ‘দ্রুত তাদের বিচার করা’ এবং এরপর তাদেরকে আরও সিনিয়র কর্মকর্তাদের আইনি প্রক্রিয়ায় সাক্ষী হিসেবে কাজে লাগানো।

আইসিসির প্রক্রিয়া প্রথমে আটকে গিয়েছিল কারণ মিয়ানমার আইসিসি সনদে স্বাক্ষর করেনি। কিন্তু আইসিসি গত বছর জানিয়েছে যে, তাদের এ ঘটনায় বিচারিক কর্তৃত্ব রয়েছে কারণ এই ঘটনার কারণে ঘরবাড়িহারা রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, যে দেশটি আইসিসি’র সদস্য।

আইসিসি সাধারণভাবে যদিও সবচেয়ে সিনিয়র কমাণ্ডারদের বিচার করে থাকে, কিন্তু এই ঘটনায় হেফাজতে থাকা দুজনও বিচারের মুখোমুখি হতে পারে, আবার সাক্ষী হিসেবেও তাদেরকে ব্যবহার করা হতে পারে।

এ ব্যাপারে মন্তব্যের জন্য মিয়ানমার সরকারের কর্মকর্তাদের সাথে যোগাগের চেষ্টা করেও সফল হয়নি সিবিসি নিউজ।

তারা বাংলাদেশে নেই

বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক লিগ্যাল কাউন্সিল হিসেবে কাজ করেন পায়াম আখাভান। তিনি বলেন যে, গত মাসে সীমান্তে মিয়ানমারের দুজন নাগরিক হাজির হয়ে বাংলাদেশ সরকারের কাছে সুরক্ষা চেয়েছিলেন, কিন্তু “তাদের পরিচয় প্রকাশ বা তাদেরকে কোথায় নেয়া হয়েছে, সেটা জানানোর অনুমতি আমার নেই”।

তিনি বলেন, সামরিক কমান্ডারদের আদেশে ২০১৭ সালের সহিংসতায় অংশ নেয়ার বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ তারা দিয়েছে।

আখাভান বলেন, “আইসিসি ঘোষণার অধীনে বাধ্যবাধকতার কারণে বাংলাদেশ বিষয়টি হেগের আইসিসি প্রসিকিউটরের অফিসকে জানিয়েছে”। তিনি আরও জানান, এই ব্যক্তি দুজন এখন আর বাংলাদেশে নেই।

আখাভাবন অবশ্য নিশ্চিত করেননি যে, ভিডিওতে যারা কথা বলেছেন, তারা একই ব্যক্তি কি না।

তিনি বলেন, “গণ হত্যাযজ্ঞে এ রকম বহু সেনা অংশ নিয়েছিলো”।

তাদের বক্তব্য যদি তদন্তে সত্যি প্রমাণিত হয়, তাহলে তাদের দেয়া তথ্যে এটা নিশ্চিত হবে যে, হত্যাযজ্ঞের বিষয়টি বিচ্ছিন্ন কিছু ছিল না, এবং উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশেই এটা সঙ্ঘটিত হয়েছিল”।

তিনি বলেন, ভুক্তভোগিদের জন্য এতে কিছু আশাও সৃষ্টি হবে এবং তারা ন্যায়বিচারের আশা করতে পারবে।

“দায়মুক্তির এখানে কোন সুযোগ নেই। সীমাবদ্ধতা থাকলেও আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করতে হবে। কিছুই বিচার না হওয়ার চেয়ে সামান্য কিছু হওয়াটাও ভালো”।

সূত্র: সিবিসি নিউজ

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: আইসিসি, মিয়ানমার, রোহিঙ্গা
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন