আলোচনার মাধ্যমে আদিবাসীদের স্বীকৃতি দিতে হবে: পর্যটন মন্ত্রী

menon

স্টাফ রিপোর্টার:

আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ‘আদিবাসী’দের ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতি প্রদানের দাবি জানালেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। তিনি বলেছেন, ‘এখন থেকে ৪৪বছর আগে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা জাতিগত অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। এর জন্য অনেক রক্ত দিতে হয়েছে। আমরা আদিবাসী-বাঙালী ঐক্যবদ্ধভাবে সেই লড়ায়ে অংশগহণ করেছিলাম। তাই বাংলাদেশ শুধু বাঙালীদের নয়, এই দেশ বিভিন্ন জাতি বৈচিত্রের দেশ, এই দেশ আদিবাসীদের দেশ।’

রোববার দুপুরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম আয়োজিত সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

পর্যটনমন্ত্রী বলেন, ‘অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সন্তু লারমা যখন আন্দোলন করেছিল, দুর্ভাগ্য আমরা তখন তাদের বাঙালী হতে বলেছিলাম। আমরা পাহাড়কে বাঙালীদের ভূমি বানানোর চেষ্টা করছিলাম। ’

তিনি আরও বলেন, ‘নব্বইয়ের দশকে আমরা বলেছিলাম- আদিবাসীদের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান দিতে হবে। তাদের সংবিধানে স্থান দিতে হবে। কিন্তু আমরা আদিবাসীদের আদিবাসী হিসেবে মেনে নিতে পারলাম না। সর্বশেষ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে আদিবাসী স্বীকৃতি দেবার সুযোগ এসেছিল, আমরা চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সংবিধানে তাদের ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ হিসেবে সন্তুষ্ট থাকতে হল। এতে কি আদৌ তারা সন্তুষ্ট হয়েছে বরং তারা এটাকে চরম লজ্জা ও লাঞ্ছনার কারণ মনে করে।’

রাশেদ খান মেনন উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ’শান্তি চুক্তির মূল উদ্দেশ্য ছিল পাহাড়ের ভূমি সমস্যা সমাধানের জন্য ভূমি কমিশন প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু এখনো তা কার্যকর করা হয়নি। এমনিভাবে সমতলের আদিবাসীদের জন্য ভূমি কমিশন প্রতিষ্ঠা করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। উত্তর বঙ্গের সমতলের আদিবাসীরা হত্যা-ধর্ষণ-উচ্ছেদের শিকার হচ্ছে।’

সংবিধানের আগামী সংশোধনীতে ’আদিবরসী’দের স্বীকৃতি প্রদান করা হবে আশা ব্যক্ত করে মেনন বলেন, ‘আদিবাসীদের অধিকার বিষয়ক আইনটি আইনে পরিণত করার ব্যবস্থা করা হবে। এজন্য সকল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।’ আগামীদিনে বাঙালী-‘আদিবাসী’ সম্মিলিতভাবে দিবসটি উদযাপন করবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

পার্বত্য চট্রগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমার সভাপতিত্বে এবং ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং এর সঞ্চালনায় সমাবেশে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, জাতিসংঘের আবাসিক কো-অর্ডিনেটর, আইএলও’র কান্ট্রি ডিরিক্টেরসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ইউএনডিপির প্রতিনিধিবৃন্দ।

এছাড়া আরো উপস্থিত ছিলেন, ঐক্যন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্রাচার্য, বিশিষ্ট কলামিস্ট ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ, আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাসের সভাপতি ফজলে হোসেন বাদশা এমপি, ঢাবি অধ্যাপক মেসবাহ কামাল, ড. সাদেকা হালিমা, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, ড. সামিম ইমাম, ব্যারি. ফারাহ হোসেন, নোমান আহমেদ খান, খুশী কবির প্রমুখ।

110সমাবেশের শুরুতে আদিবাসী দিবস উপলক্ষে জাতিসংঘ মহাসচিবের বাণী পড়ে শোনানো হয়। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল- ‘২০১৫-উত্তর এজেন্ডা: আদিবাসী জাতিসমূহের জীবনধারা উন্নয়ন নিশ্চিতকরণ’। এছাড়া বক্তব্যের ফাঁকে ফাঁকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারী শিল্পীরা গানের তালে তালে মনোজ্ঞ নৃত্য পরিবেশনা করে।

মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, ’পাহাড়ের যে সমস্যা তা বাঙালী বনাম আদিবাসী নয়, এই সমস্যা রাষ্ট্রের উপরস্থ কিছু মহলের বনাম আদিবাসীদের। বাঙালী বনাম আদিবাসীদের সমস্যা বললে তা হতে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হতে পারে। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল একটি সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন করা। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর স্বীকৃতি ছাড়া এবং তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন পূরণ করা অদৌ সম্ভব নয়।’

কোন একটি অঞ্চলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি, মুক্তচিন্তাহীনতা থাকলে তা সমস্ত সমাজে ব্যাধির ন্যায় ছড়িয়ে পড়ে মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, ‘এসব থেকে উৎসাহিত হয়ে নীলয় হত্যার মতো ঘটনা ঘটেছে। আদিবাসীদের সমস্যার মধ্যে রেখে আমরা সামনে এগুতে পারব না। রাষ্ট্রকে মানবিক/আদিবাসী বান্ধব হতে হবে। যাতে বিচারহীনতার পরিস্থিতি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।’ তিনি সন্তু লারমার উদ্দেশ্যে বলেন, ’আপনি মানবাধিকার কমিশনকে সময় দিন। আমরা চেষ্টা করি রাষ্ট্র ও আদিবাসীদের মধ্যে যে অবিশ্বাস-অনাস্থা সৃষ্টি হয়েছে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তা কাটিয়ে ওঠা যায় কিনা।’ এসময় তিনি সমাবেশে উত্থাপিত দশ দফা দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ’আমি আশা করি আদিবাসী দিবস উপলক্ষে জাতিসংঘ মহাসচিব যে বাণী দিয়েছেন সরকার তা মেনে নেবে। সংবিধানকে সমুন্নত রেখে আমাদের সকল জাতিগোষ্ঠীকে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।’ এদেশ সকল নৃগোষ্ঠীর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন হয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘শিক্ষা ও সংস্কৃতির মাধ্যমে সকল জাতিগোষ্ঠির মধ্যে বৈষম্য দূর করা সম্ভব। মাতৃভাষায় আধুনিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারলেই আমরা সকল বিভাজনের উপরে উঠে আসতে পারব।’

সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি সন্তু লারমা বলেন, ‘আজ বাংলাদেশের আদিবাসী সমাজ সকল প্রকার অত্যাচার-নিপীড়নের শিকার। সরকার আদিবাসীদের প্রতি নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। তাই মৌলিক অধিকার নিয়ে বাঁচতে হলে আমাদের আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হবে। আদিবাসী যুবকদের অগ্রগামী ভূমিকা রাখতে হবে। সকল আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।’ পার্বত্য চট্রগ্রামের বাস্তবতায় মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আজও পার্বত্য চট্রগ্রাম সেনাবাহিনীর শাসন মুক্ত হয়নি। সরকার এখনো চুক্তি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেনি। আমরা সম্মান-মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে চায় কিন্তু সরকার তা বোঝে না। যে জাতি লড়াই করতে জানে তারা কভু হারেনা। আদিবাসীরা আজ জেগে উঠেছে।’ তিনি সমতলের ’আদিবাসী’দের অধিকার পূরণের জন্যও দাবি জানান।

সমাবেশে সৈয়দ আবুল মকসুদ জাতিসংঘ মহাসচিবের বাণীর সাথে বাংলাদেশের চেতনার সামঞ্জস্য রয়েছে উল্লেখ করে সরকারের কাছে প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘আপনারা শান্তি চুক্তি করে ১৭ বছরেও কেন তা বাস্তবায়ন করতে পারলেন না, কিসে আপনাদের বাধা সৃষ্টি করেছে, তার একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করেন। এর জন্য আপনারা কি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন?

রাষ্ট্র ‘আদিবাসী’দের চরমভাবে লাঞ্ছতি করছে উল্লেখ করে ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্রাচার্য বলেন, ’আদিবাসীদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হবে, তারা ধর্ষিত হবে কিন্তু বিচার করা হবে না। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতিই প্রমাণ করছে নারী নেতৃত্বেও নারীর অধিকার মিলছেনা।’ সংখ্যালঘুদের জমির প্রতি মন্ত্রী-এমপিদের লোভ বেশি উল্লেখ করে তিনি তাদের প্রতি হুশিয়ারী উচ্চারণ করেন।

100সমাবেশ শেষে প্রধান অতিথিসহ বিশেষ অতিথিবৃন্দদের নিয়ে একটি র‌্যালি বের করা হয়। র‌্যালিটি শহীদ মিনার থেকে শুরু হয়ে টিএসসি ঘুরে আবার শহীদ মিনারে এসে শেষ হয়। র‌্যালিতে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, খাসিয়াসহ পাহাড় ও সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ছাত্র সংগঠন তাদের দাবি-দাওয়া সংবলিত বিভিন্ন ব্যানার-ফেস্টুন সহকারে অংশগ্রহণ করে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন