এক বছর ধরে মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন শাহপরীরদ্বীপের ৪০ হাজার মানুষ

মুহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান, টেকনাফ :
দেশের মূল ভুখন্ডের সর্বদক্ষিন জনপদটির নাম শাহপরীরদ্বীপ। ৪০ হাজার জনঅধ্যুষিত শাহপরীরদ্বীপের সাথে দ্বীপ শব্দটি যুক্ত থাকলেও এটি আসলে দ্বীপ নয়। তবে গত এক বছর ধরে শাহপরীরদ্বীপের জনগন বসবাস করছেন দ্বীপের বাসিন্দাদের মতোই। গত বছরের ২২ জুলাই বঙ্গোপসাগরের প্রবল জোয়ারের তোড়ে শাহপরীরদ্বীপ রক্ষা বাঁধ বিধবস্ত হয়ে টেকনাফ-শাহপরীরদ্বীপ সড়কের কয়েক ফুট অংশ অংশ ভেঙ্গে যায়। ক্রমান্বয়ে সেই সড়ক ভাঙতে ভাঙতে এখন প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ হয়েছে।

শাহপরীরদ্বীপের লোকজন গত এক বছর ধরে নৌকা অথবা স্পীড ভোটে সড়কের এই ভাঙ্গা অংশ পার হয়ে যাতায়াত করছে। সাবরাং ইউনিয়নের ৩টি ওয়ার্ডের ৪০ হাজারের অধিক জনসংখ্যার এই শাহপরীরদ্বীপে ভোটার সংখ্যা ১০ হাজারের কাছাকাছি। উপজেলা সদর, থানা, হাসপাতাল এমনি ইউনিয়ন কমপ্লেক্সে যেতেও তাদের এই যাতায়াতের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের মধ্যে পড়ছে অসুস্থ্য রোগী, নারী ও বয়স্করা। এর মধ্যে ঘটছে আবার দুর্ঘটনা।

যাতায়াতের অভাবে ব্যবসা-বানিজ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা সবক্ষেত্রে পড়েছে এর নেতিবাচক প্রভাব। একদিকে সড়ক যাতায়াত না থাকা অন্যদিকে বিধবস্থ বেড়ী বাঁধ দিয়ে সাগরের লোনা জলে বাড়ি-ঘর, ফসলের মাঠ, চিংড়ি ঘের, লবণের মাঠ সবকিছু প্লাবিত হওয়া। শুধু তাই নই বেড়ী বাঁধ বিলীন হওয়ার পর শাহপরীরদ্বীপ পশ্চিম পাড়ার শতাধিক বসতবাড়ী কয়েকশত একর ফসলী জমি সাগর গর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছে।

এই শাঁখের করাতের মধ্যে পড়ে শাহপরীরদ্বীপবাসী তাদের এই নিত্য দুর্ভোগের পেছনে ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্বের ব্যর্থতাকে দায়ী মনে করছেন। কেননা স্থানীয় সংসদ সদস্য ও টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান দু’জনেই ক্ষমতাসীন দলের। ফলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে শাহপরীরদ্বীপের ১০ হাজার ভোটার ক্ষমতাসীনদের পরাজয়ের প্রধান কারন হয়ে দাড়াঁতে পারে এমনটাই মনে করছেন স্থানীয়রা।
শাহপরীরদ্বীপ রক্ষা বাঁধটি সংস্কারে কয়েক দফা ব্যর্থ চেষ্টা ও করা হয়। অভিযোগ উঠেছে যথাযথভাবে বাঁধ সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। যেনতেন ভাবে লোক দেখানো সংস্কারের নামে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা লুপাট করা হয়েছে। এরমধ্যে নিয়ম বহির্ভূতভাবে ২০১২-১৩ অর্থ বছরের হতদরিদ্রের কর্মসৃজন প্রকল্পের ৫০০ শ্রমিকের বরাদ্দের প্রায় ৩৫ লক্ষ টাকা, স্থানীয় সাংসদ ও স্থানীয় লবণ চাষীদের ব্যক্তিগত সহায়তার প্রায় ২০ লক্ষাধিক টাকা শাহপরীরদ্বীপের বিধস্ত বেড়ী বাঁধ মেরামতের নামে লোপাট করা হয়েছে।

সাবরাং ইউপি চেয়ারম্যান হামিদুর রহমান জানালেন, বেড়ী বাঁধ সংস্কারের যথাসাধ্য চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু বিধস্ত অংশে পানির গভীরতা বেড়ে যাওয়া ও আগাম বর্ষা চলে আসায় বেড়ীবাঁধ সংস্কার সম্ভব হয়নি। এছাড়া বেড়ী বাঁধ সংস্কার না হওয়ায় টেকনাফ-শাহপরীর দ্বীপ সড়ক সংস্কারের জন্য ইতিমধ্যে বরাদ্দ ও টেন্ডার সম্পন্ন হওয়া প্রায় ১৮ লক্ষ টাকার কাজে হাত দেওয়া যাচ্ছে না বলে তিনি জানান।

এর আগে ২০১১-১২ অর্থ সনে কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) টেকনাফ শাহপরীরদ্বীপ বাঁধ ও ব্লক নির্মানে দুই প্যাকেজে ৭ কোটি টাকা কাজের ঠিকাদার নিয়োগ দিয়েছিল মের্সাস উন্নয়ন ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে। ২০১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারী এ কাজ দুইটি ৪ মাস এবং ৫ মাস নির্ধারন করে ওর্য়াক অর্ডার প্রদান করে পাউবো। সে সময় উক্ত কাজ দুটি যথাসময়ে এবং যথাযথভাবে না করায় ৭ কোটি টাকার বেড়ী বাঁধ সংস্কারের প্রকল্প দুটির কাজ শেষ করা যায়নি। ফলে জুনের বর্ষা ও অতিজোয়ারে বেড়ী বাঁধে আবারও ভাঙ্গন ধরে এবং পরে জুলাই মাসে এসে এ বাঁধের বড় অংশ সাগরে বিলীন হয়ে যায়। নিম্ন মানের কাজ ও ধীরগতি নিয়ে সেসময় সংবাদ প্রকাশের পাশাপাশি বিভিন্ন মহল থেকে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হলেও কর্ণপাত করেনি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান জানিয়েছিল পানি উন্নয়ন বোর্ডের সময় মতো টাকা ছাড় না করার ফলে কাজের গতি সঞ্চার হয়নি।
তারও আগে ১৯৯১ সালে ২৯ এপ্রিল প্রলয়ংকারি ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে শাহ্পরীরদ্বীপ বঙ্গোপসাগর রক্ষাকারী বেড়িবাঁধ অনেকাংশ ভেঙ্গে পড়েছিল। এরপর থেকে বছর বছর সংস্কারের নামে টাকা ঢালা হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী গিয়াস উদ্দীন জানান, শাহপরীরদ্বীপ পশ্চিম পাড়া বেড়ী বাধেঁর জরুরী সংস্কারের জন্য ইমার্জেন্সেী ওয়ার্কের আওতায় ইতিমধ্যে ৮০ লক্ষ টাকার বরাদ্দ ও টেন্ডার সম্পন্ন হয়েছে। বর্ষা মৌসুম শেষ হলেই এই প্রকল্পের কাজ শুরু হবে । অপরদিকে শাহপরীরদ্বীপে বেড়ী বাঁধ নির্মাণের একশ কোটি টাকার অপর একটি প্রকল্প বিশ্ব ব্যাংকের পরীক্ষাধীন আছে বলে তিনি জানান।

এদিকে ১৯ জুলাই শুক্রবার বিকালে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব, ও সড়ক ও জনপদ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী শাহপরীরদ্বীপ সড়কের ভগ্নাংশ পরিদর্শন করেছেন বলে জানা গেছে। এসময় স্থানীয় সংসদ সদস্য ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার সফর সঙ্গী ছিলেন।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন