এবার হাল্কা বাতাসেই ছিঁড়ে পড়লো তার: ৬ কোটি টাকার মরণফাঁদ কাউখালী সাবস্টেশন!

Kaukhali Substation News- pic-1-11-05-2015

আরিফুল হক মাহবুব, কাউখালী:
এবার হাল্কা বাতাসেই পরীক্ষামূলকভাবে চালু হওয়া কাউখালী সাবস্টেশনের ৩৩ হাজার কিলোভোল্টের দুইটি ইনস্যুলেটেড ক্যাবল পুড়ে গিয়ে গলে মাটিতে ছিড়ে পড়েছে। এতে অল্পের জন্য তিন মটরসাইকেল আরোহী প্রাণে রক্ষা পেলেও প্রায় ছয় ঘণ্টা বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে পড়ে উপজেলার সাড়ে পাঁচ হাজার গ্রাহক।

এনিয়ে নতুন এই সঞ্চালন লাইনটির তার (ক্যাবল) তিন দফায় পুড়ে গিয়ে গলে মাটিতে ছিড়ে পড়ার ঘটনায় দুজনের প্রাণহানির কারণে এলাকাবাসির কাছে এটি মরণফাঁদ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

সোমবার (১১ মে) সকাল পৌনে ১১টার দিকে উপজেলার ছিদ্দিক আকবর দাখিল মাদরাসার সামনে এঘটনা ঘটে।

মুর্হুতেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে পথচারী ও এলাকাবাসির মধ্যে। বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচলও। এলাকাবাসি অভিযোগ করেছেন, সরকারি অর্থ হাতিয়ে নিতেই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক প্রভাব খাঁটিয়ে লাইন সম্প্রসারণ কাজ অব্যাহত রেখেছে। একইসাথে দ্রুত এসব নিম্নমানের ক্যাবল পরিবর্তন করে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন টানারও দাবি করেছেন।

বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে প্রায় সোয়া ছয় কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ কাজ চলছে সাবস্টেশনটির। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আরমান এন্টারপ্রাইজ তিন কোটি ১৫ লাখ টাকা বরাদ্দে প্রায় সাত কিলোমিটার ৩৩ হাজার কিলোভোল্টের লাইন সম্প্রসারণ কাজ পায়। কাউখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এরশাদ সরকার প্রতিষ্ঠানটির সত্ত্বাধিকারী হলেও কাজটি সাব কন্ট্যাক্টে করছে উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক নাজিম উদ্দিন। অবশ্য অভিযোগ আছে সাবস্টেশন স্থাপন ও ৩৩ হাজার কিলোভোল্টের লাইন সম্প্রসারণ কাজের কোন অভিজ্ঞতাই আরমান এন্টারপ্রাইজের নেই।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আরমান এন্টারপ্রাইজ’র সত্ত্বাধিকারী এরশাদ সরকার বলেন ‘বিদ্যুৎ বিভাগ মালামাল সরবরাহ করেছে, আমরা শুধু কাজ করছি, ক্যাবল নিম্নমানের হলে কর্তৃপক্ষ বুঝবে, আমাদের কী?’ তবে সোমবারের ক্যাবল ছিঁড়ে পড়ার কারণ হিসেবে গাছের ডাল ভেঙে পড়েছে বলে দাবি করলেও প্রায় ৩০ বছর ধরে পুরনো বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন কেন একবারও ছিঁড়ে পড়েনি এমন প্রশ্নে জবাব দিতে পারেননি তিনি।

জানা গেছে, প্রায় ৯০ কিলোমিটার দৈর্ঘের বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের কাউখালীতে বর্তমানে লোড আছে আড়াই মেগাওয়াট। এর মধ্যে প্রায় সাত মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন এই সাবস্টেশন থেকে শুধুমাত্র উপজেলা সদরে পরীক্ষামূলক আধা মেগাওয়াটের লোড দেওয়াতেই ক্যাবল পুড়ে গলে গিয়ে মাটিতে ছিঁড়ে পড়ছে বারবার।

গত ২০ মার্চ সকালে উপজেলা সদরের অদূরেই কাউখালী-রানীহাট সড়কের বেতছড়ি পাইন বাগান এলাকায় বিদ্যুতের ক্যাবল পুড়ে গিয়ে গলে আজিমের চা দোকানের উপরে আছড়ে পড়ে। এতে দগ্ধ হয়ে মারা যান আজিমের স্ত্রী রহিমা বেগম (৪৫) ও তার মেয়ের ঘরের একমাত্র নাতি মোঃ অনিক (৬)। চোখের সামনেই বিদ্যুতের আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে ছটফট করার দৃশ্য এখনো ভুলতে পারেননি এলাকাবাসি।

এর আগে গত ৪ ফেব্রুয়ারি আধাঘণ্টার গুড়িগুড়ি বৃষ্টিতেই কাউখালী-রাণীরহাট সড়কে সেগুন বাগান এলাকায় আকস্মিকভাবে সঞ্চালন লাইনটির দুইটি ইনস্যুলেটেড ক্যাবল (প্লাস্টিকের কভার লাগানো তার) পুড়ে গিয়ে গলে মাটিতে ছিঁড়ে পড়ে। তবে কোন হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও প্রায় আট ঘণ্টা পরে বিকল্প উপায়ে বিদ্যুৎ সঞ্চালন স্বাভাবিক হয়।

সোমবারের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় বাসিন্দা শহিদুল আলম (৪০), মোঃ হযরত (৩২) অভিযোগ করেন, ক্যাবল ছিঁড়ে পড়ার সময় অল্পের জন্য তিন মোটরসাইকেল আরোহী প্রাণে বেঁচে গেছেন। প্রতিদিনই সড়ক দিয়ে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী, গ্রামবাসি, পথচারি যাতায়াত করছেন কিন্তু গত দুই মাসে তিন দফায় এধরণের ঘটনায় এই লাইনের নিচে দিয়ে যাওয়ার সময় প্রাণ শুকিয়ে আসে।

গৃহবধূ সাহানা আক্তারের (৩৭) সোজাসাফটা দাবি ‘যে বিদ্যুতের লাইন আলোর চাইতে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে বেশি, সেই লাইন আমরা চাইনা। এসব পঁচা তার খুলে ভালো তার লাগাক সরকার।’

এদিকে দুপুরেই কাউখালী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান চৌচামং চৌধুরী ও ইউএনও আফিয়া আখতার ঘটনাস্থলে পরিদর্শনে আসেন। ইউএনওর এক প্রশ্নের জবাবে ‘লাইন এখনো বুঝে নেইনি’ এমন মন্তব্য করায় বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন ঠিকাদার এরশাদ সরকার। তবে ইউএনও আফিয়া আখতার জানান, এটি আতঙ্কজনক, উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি দ্রুত জানানো হবে।

কাউখালী বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আবাসিক প্রকৌশলী হাসির উদ্দিন মিয়া বলেন, প্রায় ৩০ বছর ধরে পুরনো বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের উপর প্রায় প্রতিদিনই গাছ-বাঁশ ভেঙে পড়লেও একবারও ক্যাবল ছিঁড়ে পড়েনি। আর হালকা বাতাসেই নতুন লাইন ছিঁড়ে পড়ছে বারবার। তার মতে, অত্যন্ত নিম্নমানের এই ক্যাবল দিয়ে ১১ হাজার কিলোভোল্ট লাইন কোনভাবে চালানো গেলেও এটি দিয়ে ৩৩ হাজার কিলোভোল্ট লাইন টানিয়ে কাউখালীর জন্য একটা মরণফাঁদ তৈরি করা হচ্ছে।

এখনো নতুন এই সঞালন লাইনের কাজ বুঝে নেননি দাবি করে তিনি বলেন, বারবার উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে বলেও কোন সুরাহা পাচ্ছিনা। তিনি জানান, আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি যাতে কাজ শেষ হওয়ার আগেই যাতে এখান থেকে অন্যত্র চলে যেতে পারি। নচেৎ ত্রুটিপূর্ণ এই সাব স্টেশনের কাজ আমাকেই বুঝে নিতে হবে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন