জেএসএস সামরিক কমাণ্ডার রণকৌশল চাকমা নিহত?

fec-image

জেএসএস সামরিক কমাণ্ডার রণকৌশল চাকমা নিহত হয়েছে এমন খবর গত কয়েকদিন ধরেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচিত হচ্ছে। তিনি নিহত নাকি জীবিত এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাল্টাপাল্টি আলোচনা চলছে।

গত ১৭ এপ্রিল রবিবার দুপুরে খবর পাওয়া যায়, বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলা ও রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলাধীন বিলাইছড়ি উপজেলার সীমান্তবর্তী বিলাইছড়ির বড়থলি ইউনিয়নের বিলপাড়া/সাইজাম পাড়া (তঞ্চঙ্গ্যা পাড়া) এলাকায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি(সন্তু) গ্রুপের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের সাথে নতুন আত্মপ্রকাশ করা কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট(কেএনএফ) এর সামরিক শাখা কুচি-চিন ন্যাশনাল আর্মি(কেএনএ) মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষের খবর পাওয়া যায়। হতাহতের খবরও শোনা যায়। কিন্তু ঘটনাস্থল অত্যন্ত দূর্গম হওয়ায় এ ব্যাপারে কেউই কোনো নিশ্চিত খবর দিতে পারছিলেন না। এদিকে খবরটি শোনার পর যৌথ বাহিনীর একটি দল ঘটনাস্থলের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। বেশ কয়েক ঘন্টা দূর্গম পথ পেরিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে কোনো লাশ বা হতাহতের কোনো অস্তিত্ব পায়নি। তবে স্থানীয়রা তাদের কাছে গোলাগুলির খবর এবং একাধিক হতাহতের খবর নিশ্চিত করে।

এ ঘটনার পর স্যোশাল মিডিয়ায় জেএসএসের সশস্ত্র শাখার অন্যতম শীর্ষ কমান্ডার ও প্রশিক্ষক রণকৌশল চাকমা নিহত হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়। তবে জেএেএসের পক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে এ ধরণের খবরের কোনো জবাব দেয়া হয়নি। তবে জেএসএস সমর্থিত একাধিক ফেসবুক আইডি থেকে এ খবর অস্বীকার করা হয়। কিন্তু অপরপক্ষ কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট তাদের ফেসবুক পেইজে সরাসরি রণকৌশল চাকমাকে সরাসরি হত্যার দাবী করা হয়েছে। তবে পার্বত্যনিউজের নিজস্ব অনুসন্ধানে জানা যায়, এ ঘটনায় জেএসএসের একজন কমাণ্ডার ঘটনাস্থলেই মারা যায় এবং কোমরে গুলিবিদ্ধ আরেকজন পরে মারা যায়। দু’জনই চাকমা সম্প্রদায়ের। তবে কুকি-চিন পক্ষের কারো হতাহতের কোনো তথ্য নিশ্চিত করতে পারেনি সূত্রটি।

এদিকে এ ঘটনার পর জেএসএস সমর্থক অনলাইন নিউজ পোর্টাল হিলভয়েজে এ সংক্রান্ত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘‘কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সমর্থকদের উপর বিশ্বাসঘাতকতামূলক এক অতর্কিত সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এই হামলায় চুক্তি সমর্থক এক নিরীহ ব্যক্তি নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। এই ঘটনাটি গত রবিবার ১৭ এপ্রিল ভোরের দিকে বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলা ও রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলাধীন বিলাইছড়ি উপজেলার সীমান্তবর্তী বিলাইছড়ির বড়থলি ইউনিয়নের বিলপাড়া/সাইজাম পাড়া (তঞ্চঙ্গ্যা পাড়া) এলাকায় ঘটেছে বলে এলাকাবাসীর সূত্রে খবর পাওয়া গেছে। ঘটনায় নিহত ব্যক্তির নাম এ্যাকশন চাকমা বলে জানা গেছে। প্রতিপক্ষের কোনরূপ উস্কানী ছাড়াই বমপার্টি এই সশস্ত্র আক্রমণ চালায় বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চুক্তি সমর্থক স্থানীয় এক গ্রামবাসী জানান। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কয়েকদিন আগে পার্বত্য চুক্তি সমর্থক কয়েকজন কর্মী রুমা উপজেলার সীমান্তবর্তী বিলাইছড়ির বড়থলি ইউনিয়নে সাংগঠনিক কাজ শুরু করেন। গত ১৬ এপ্রিল ২০২২ তারা বিলপাড়া গ্রামে জনৈক এক গ্রামবাসীর বাড়িতে রাত্রি যাপন করেন।“

নিউজ পোর্টালে ঘটনার বর্ণনায় বলা হয়েছে, “ ১৭ এপ্রিল ভোর প্রায় ৪:০০ টার দিকে বমপার্টির সশস্ত্র সদস্যরা কোনরূপ উস্কানী ছাড়াই চুক্তি সমর্থক কর্মীদের উপর অতর্কিত সশস্ত্র হামলা চালায়। এই হামলায় এ্যাকশন চাকমা নামে একজন কর্মী প্রস্রাব করার জন্য বাড়ি থেকে বের হলে গুলিবিদ্ধ হন। এতে তিনি ঘটনাস্থলে নিহত হন। এছাড়া স্থানীয় একজন নিরীহ তঞ্চঙ্গ্যা গ্রামবাসীও আহত হন বলে জানা গেছে। পার্বত্য চুক্তির বিরোধিতা করলেও কোন উস্কানী ছাড়াই বমপার্টির সশস্ত্র সদস্যরা একতরফাভাবে চুক্তি সমর্থক কর্মীদের উপর এভাবে অতর্কিত সশস্ত্র হামলা করবে এটা তারা ভাবতে পারেনি বলে চুক্তি সমর্থক একজন কর্মী জানান। তিনি বলেন, বমপার্টি যে অধিকারের জন্য আন্দোলন করছে বলে দাবি করছে, সেই দাবি তো সরকার থেকেই আদায় করতে হবে। তাই আন্দোলনরত আরেকটি গোষ্ঠীর উপর এভাবে এত শীঘ্রই সশস্ত্র আক্রমণ করবে তা ভাবা যায়নি।“

রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, “এই উস্কানীমূলক হামলায় দায় স্বীকার করে ১৮ এপ্রিল কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট তাদের ফেসবুক একাউন্টে উল্লেখ করে যে, ‘গতকাল রাত থেকে সারাদিন আমাদের কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ)-র “হেড হান্টার টিম”-এর দক্ষ কমান্ডোগণ অপারেটিভ ছিল।’ ১৯ এপ্রিল আরেক স্টাটাসে কেএনএফ একইভাবে উল্লেখ করে যে, “আমাদের সুদক্ষ “হেড-হান্টার” কমান্ডোগণ দক্ষতার সাথে প্রতিপক্ষ জেএসএস’র জেএলএ নামক কমান্ডো ফোর্সকে পুরোপুরি সফলভাবে ঘায়েল এবং পরাস্ত করতে সক্ষম হয়েছে।… বমপার্টি সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা কেবল সশস্ত্র হামলার দায় স্বীকার করেনি, সেই সাথে হুমকিও দিয়ে চলেছে। ১৯ এপ্রিল দেয়া আরেক ফেসবুক স্টাটাসে বমপার্টি সন্ত্রাসীরা হুমকি দেয় যে, ‌‌‘মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করলে অতীতের ন্যায় পার্বত্য চট্টগ্রামে দূর্ধর্ষ কুকি বিদ্রোহ আবার শুরু হবে।‘

রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, “আবির্ভাব হওয়ার সাথে সাথে এই সংগঠনটি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী ও জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে এবং চাকমা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক উস্কানীমূলক প্রচারনণা শুরু করে। কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট নামে বমপার্টির নিজস্ব ফেসবুক একাউন্টে ৩০ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে প্রচার করা হয় যে, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জুম্মল্যান্ড নয়, এটি কুকি-চীন টেরিটোরি।‘ উক্ত ফেসবুক একাউন্টে আরো বলা হয় যে, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তিচুক্তি এবং তাদের গঠিত আঞ্চলিক পরিষদ কুকি-চীন জনগোষ্ঠীদের জন্যে নয়, এটা একটা চাকমা চুক্তি এবং চাকমা জনগোষ্ঠীদের উন্নয়নমূলক পরিষদ মাত্র।‘ “

অপরদিকে একই ঘটনা নিয়ে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট(কেএনএফ) এর ফেসবুক পেইজে সম্পূর্ণ ভিন্ন দাবী করে বলা হয়েছে, ”পার্বত্য চট্টগ্রামের সন্ত্রাসী দল জেএসএস (সন্তু লারমা) সংগঠনের নেতৃবৃন্দের পরিকল্পনা মোতাবেক এবং হাই-কমান্ডের নির্দেশে জেএসএস-এর তথাকথিত কমান্ডো ফোর্স “জুম্মল্যান্ড লিবারেশন আর্মি (জেএলএ)” কেএনএফ-এর অবস্হানে আক্রমণ করে পুরোপুরি নির্মূলের উদ্দেশ্যে রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি থানার বড়থলি ইউনিয়নের জেএসএসপন্হী চাকমা গ্রাম বিলপাড়াতে আসে। এটি ছিল ১৬ তারিখ দুপুর। সম্ভবত তাদের উদ্দেশ্য ছিল পরদিন ১৭ তারিখ খ্রীষ্টানদের ধর্মীয় দিন ইস্টার-সানডে দিনেই হয়তো কেএনএফদের আস্তানাতে ধ্বংসাত্মক হামলা চালাবে।”

ছবিঃ কেএনএফ সশস্ত্র গেরিলার মহিলা সেকশন

 

কেএনএফ হেডকোয়ার্টারস্, সিএইচটি থেকে  কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) এর তথ্য, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক লে. কর্ণেল সলোমন এর বরাতে পোস্টকৃত বার্তায় দাবি করা হয়েছে, “একটি বিশেষসূত্রে জানা গেছে, নীলনক্সাটি প্রণয়ন করা হয়েছিল রাঙ্গামাটির জেএসএস-এর কেন্দ্রীয় কমিটিগণ। সেই ধারাবাহিকতায়, সন্ত্রাসীরা শনিবারে বিকেলে কারবারীর মাধ্যমে তাদের কমান্ডার রণকৌশল চাকমা কেএনএফ-এর কমান্ডারকে একটি চিঠি পাঠান। চিঠিতে উল্লখ করেছে কেএনএফ সংগঠন সেনাবাহিনীর মদদপুষ্ট সংগঠন আর ডিজিএফআইয়ের দালাল। আর এক সপ্তাহের মধ্যে কেএনএফ সদস্যেদের সবাইকে নিজ জন্মভূমি বাংলাদেশ ত্যাগ করতে হবে নাহলে কেএনএফ-এর সাথে যুদ্ধ করবে ইত্যাদি হুমকিস্বরূপ বাক্যগুলি তারা ব্যবহার করে। তাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৪০-৫০ জনের মতো, সবাই সশস্ত্র।

চিঠিটি পাওয়ার পরপরই চিঠির উত্তর দিতে কেএনএফ-এর সুদক্ষ ১২ জনের একটি কমান্ডো স্কোয়াড ‘হেড-হান্টারস্ (Head-hunters)’ কমান্ডোগণ বিলপাড়াতে যান। কেএনএফ আর্মিরা ভোর ৩:১৫ টার দিকে পাড়াটিতে প্রবেশ করতেই অ্যাম্বুশের জন্যে উৎপেতে থাকা ডিউটিরত কেএনএফ কমান্ডোকে দেখে ফেলে এবং সাথেসাথে গুলিবর্ষণ করে। তারপর পরপরই দক্ষতার সাথে কুকি-চিন কমান্ডোরা যে যার মতো অবস্হান নেয় এবং প্রতিপক্ষ জেএসএস কমান্ডো ফোর্স (জেএলএ) দেরকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে গ্রামসুদ্ধ ঘিরে ফেলে আর তুমূল সংঘর্ষের মাধ্যমে পুরো পাড়াটি নিয়ন্ত্রণে আনে। আর সন্ত্রাসীরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বিভিন্ন ফন্দি এঁটে জনগণের সাথে মিশিয়ে গ্রামবাসী সেজে কয়েকজন গ্রাম থেকে অন্ধকারে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হন।

কেএনএফ “হেড-হান্টারস” অপারেশন টিমের তথ্য সূত্রে উক্ত পোস্টে দাবী করা হয়েছে, “কেএনএফ কমান্ডোগণ বাকী ভেতরে থাকা সশস্ত্র গ্রুপদেরকে আক্রমণ করে। কয়েক ঘন্টার যুদ্ধে জেএলএ-এর কোরসের সিনিয়র প্রশিক্ষক রণকৌশল চাকমা (!) সহ তাদের ২০ জন ফোর্স গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং ঘটনাস্হলেই মারা যান। আর গুলিবিদ্ধ বাকি ২০ জনের মতো আহতাবস্হায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। নিয়ন্ত্রণে আনার পর গ্রামে তল্লাশি চালিয়ে জেএলএদের সামরিক সরঞ্জামাদি সহ অনেককিছু পাওয়া গেছে। ঐদিন এভাবে কেএনএফ-এর সুপ্রশিক্ষিত কমান্ডোরা সান্ত্রসীদের সফলভাবে দ্রুততমপর মধ্যে ঘায়েল এবং পরাস্ত করতে সক্ষম হন। কেএনএফ কমান্ডোগণের কোন রকমের হতাহত হয়নি। একটি গোপনসূত্রে জানা গেছে, আরো জেএলএ-ফোর্সের কয়েকটি চাঁদা উত্তোলনকারী গ্রুপ থানচি ও রোয়াংছড়িতে এখনো অপারেটিভ আছে।”

পার্বত্য চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে জড়িত একাধিক সূত্র এ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে পার্বত্যনিউজকে জানিয়েছে,  “গোলাগুলির ঘটনা সত্য, রণকৌশল নিহত হওয়ার খবর তারাও শুনেছেন। তবে ঘটনাস্থলে তল্লাশি চালিয়ে কোনো লাশ পাওয়া যায়নি।”

তবে পরস্পর বিরোধী দুটি বার্তাতেই বন্দুকযুদ্ধ ও হতাহতের ঘটনা স্বীকার করা হয়েছে।উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রামে আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় হতাহত হলে দলগুলো তাদের নিজেদের হতাহত সদস্যদের গায়েব করে ফেলে। অনেক সময় গায়েব করতে না সুযোগ পেলে লাশের দাবীও অস্বীকার করে থাকে।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি, কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট, কেএনএ
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন