নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগে রাঙামাটি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা

Prees Confarence-01

আলমগীর মানিক,রাঙামাটি:
শেষ পর্যন্ত পিয়ন চৌকিদার নিয়োগেও অনিয়মের আশ্রয় নিল জেলা পরিষদ! এমন মন্তব্য করে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বরকল উপজেলার একজন অতিসাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ পলাশ চাকমা। তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে প্রাপ্য অধিকার থেকে। এভাবে জেলার প্রায় ৫০জন যোগ্য প্রার্থীকে তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে নিজেদের পছন্দমতো ও অযোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগ দিয়েছে জেলা পরিষদ।

পরিষদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ এনে সংবাদ সম্মেলনও করেছে জেলার বরকল উপজেলাবাসী ও চাকুরী বঞ্চিত প্রার্থীরা। শুক্রবার সকালে রাঙ্গামাটি স্থানীয় একটি হোটেলে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সরকারী নীতিমালা লঙ্ঘন করে বরকলে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪র্থ শ্রেণী পদে নিয়োগে ২২টি বিদ্যালয়ের মধ্যে ৬টি বিদ্যালয়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে  দূর্নীতি, অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতি করা হয়েছে।  
তাছাড়া  একই পদে নানিয়ারচর, জুড়াছড়ি, রাজস্থলীসহ আরো বেশ কয়েকটি উপজেলায় নিয়োগের ক্ষেত্রে অনিয়ম, দূর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ আনা হয়। তারা নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনার দাবী জানান।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বরকল সচেতন নাগরিক সমাজের পক্ষে পুলিন চাকমা। এসময় চাকুরী বঞ্চিত প্রার্থীসহ এলাকার গন্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।  রাজস্থলীর নিয়োগ বঞ্চিতরা মামলা করে বসেছেন খোদ জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে। বরকলে নিয়োগ বঞ্চিতরা ছাড়াও নাানিয়ারচরে নিয়োগ বঞ্চিতরা মানববন্ধনসহ আরো মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দপ্তরি কাম নৈশ প্রহরি নিয়োগে দুর্নীতি-অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি এবং ঘুষ কেলেঙ্কারীর অভিযোগে সোচ্চার হচ্ছে জেলার বিভিন্ন প্রান্তের একেবারে প্রান্তিক মানুষ। নিম্নপদের এই নিয়োগকে অবৈধ ঘোষণা করে এই নিয়োগ বাতিলের আদেশ দেওয়ার জন্য রাঙামাটি যুগ্ম জেলাজজ আদালতে মামলা করেছে রাজস্থালীর পাইউ প্র“ মারমা নামে এক চাকুরিপ্রার্থী। এই মামলায় বিবাদী করা হয়েছে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা একেএম রিয়াজ উদ্দিন, চাকুরি পাওয়া মংকা সিং মার্মা ও বাঙ্গাল হালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতিকে। মোকাবেলা বিবাদী করা হয়েছে একই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে।

মামলার আর্জিতে বলা হয়, এই সকল সরকারি পদস্থ মানুষ সরকারি নিয়ম অনুযায়ী যাবতীয় যোগ্যতা যাচাই করার পর পরীক্ষায় প্রথম ও প্রতিযোগীতা উত্তীর্ণ হওয়ার পরও বাদী পাইউ প্র“ মারমাকে বিবেচনায় না নিয়ে পক্ষপাতমুলক আচরন করেছেন। পরীক্ষায় অংশ গ্রহণকারী পাঁচজন প্রার্থীর মধ্যে বাদী প্রথম হওয়া সত্ত্বেও বিবাদীগণ পরস্পরের যোগসাজশে বাদীকে বঞ্চিত করেন। চাকুরী বিধিমালা ও এ সংক্রান্ত নীতিমালা ভঙ্গ করায় এ নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করার আদেশ চাওয়া হয় মামলার আর্জিতে। রাঙামাটি যুগ্ম জেলাজজ আদালতে গত ৩০ জুন রুজু করা এই মামলার নং ২৯১/২০১৩। আগামী ৭ জুলাই এই মামলার উপর শুনানীর দিন ধার্য করেছেন বিজ্ঞ আদালত।
চাকুরী বঞ্চিতরা দাবি করেন, সমগ্র রাঙামাটি জেলার প্রতিটি উপজেলায় এভাবেই প্রাথমিক দপ্তরী কাম নৈশ প্রহরী নিয়োগে নিয়োগে, দুনীতি, স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। চাকুরী প্রার্থীদের কাছ থেকে নেওয়া পরীক্ষার ফলাফল একপাশে সরিয়ে রেখে মুখ দেখে এবং তদবিরের ভিত্তিতে এই নিম্ন পদটিতে লোক নিয়োগ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে ২১ জন চাকুরি প্রার্থী। তারা জানায় এই নিয়োগে মেধা ও যোগ্যতার কোনো মূল্যায়নই হয়নি। দলীয় পরিচয়, টাকা, আর তদবিরই ছিল নিয়োগের মুলনীতি।

নিয়োগ বঞ্চিতরা অভিযোগ করেছে, পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের পরও তারা কেন নিয়োগ পেলোনা, এ বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গেলে তাদের জানানো হয়, ‘ইন্টারভিউটা শো, আইন অনুযায়ী চেয়ারম্যানই নিয়োগের বিষয়ে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।’ নিয়োগ বঞ্চিতদের অভিভাবকরা দাবি করেছেন, নিয়োগ কমিটির সুপারিশের পরও চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তই যদি নিয়োগের মুল প্রক্রিয়া হয়, তবে ঢাকঢোল পিটিয়ে শত শত বেকার যুবককে নিয়োগে আহ্বান জানানোসহ এত টাকা পয়সা খরচা করিয়ে লোকসানের দায় দায়িত্ব কে নেবে?  
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নতুন সৃজিত পদ দপ্তরি কাম নৈশ প্রহরি নিয়োগের এই প্রক্রিয়া শুরু হয় গত বছরের শেষ নাগাদ। প্রতি বিদ্যালয়ে একজন হিসেবে রাঙামাটি জেলায় এই পদে মোট ৯৬জন লোক নিয়োগ করা হয়। রাজস্থলী উপজেলার আরো অন্ত পাঁচটি বিদ্যালয়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে এধরনের অনিয়ম করা হয়েছে বলে দাবি করেছে চাকুরীপ্রার্থীরা।

নানয়িার উপজেলার চাকুরী প্রাথীরা জানায়, পরীক্ষায় অংশ নিয়ে যারা তৃতীয় হয়েছে তারা চাকুরী পেলো আর যারা প্রথম হয়েছে তাদের কোনো খবর নেই এমন তুঘলকি কারবারে এলাকার মানুষ ক্ষুব্ধ। বিধিমালা অনুযায়ী নিয়োগ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী চেয়ারম্যান নিয়োগ অনুমোদন করার কথা। তিনি যদি মুখ্যপ্রার্থীকে বাদ দিতে চান তবে কেন বাদ দিলেন সে বিষয়ে দিক নির্দেশনা দেওয়ার কথা বিধিমালায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকলে কোনো ক্ষেত্রেই এই বিধি অনুসরন করা হয়নি। বিধিমালায় বরং চেয়ারম্যান অনুমোদন দিতে দেরী হলে তাকে বাদ দিয়েই নিয়োগ কমিটি মুখ্যপ্রার্থীতে নিয়োগ দিতে পারেন এমন বিধান রয়েছে। এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, আমরা জানতে পেরেছি বিধিমালা সম্পর্কে চেয়ারম্যান ভুল বুঝিয়ে একটি মহল নিজেদের পকেট ভারি করেছেন। এদিকে প্রাথমকি ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েব সাইট ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে পাওয়া বিধিমালার সাথে জেলা পরিষদ ও প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের বিধিমালার মধ্যে বেশ কয়েকটি গরমিল লক্ষ করা গেছে। তড়িঘড়ি এ বিধিমালা সংশোধনে পার্বত্য জেলার জন্য দু’টি জায়গায় সংশোধন আনা হলেও অন্য জায়গায় কিছু বিধি বাদ পড়ে গেছে। চাকুরীপ্রার্থীদের মাঝে এ নিয়েও কানাঘুষা চলছে। তাছাড়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির সাথে সারাদেশের বিধিমালার মিল রয়েছে, কিন্তু নিয়োগ দেওয়া হয়েছে পার্বত্য জেলার বিধিমাল অনুযায়ী।

এ দিকে বরকল উপজেলায় অন্তত ৭টি বিদ্যালয়ে এ ধরণের অনিয়ম করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে স্থানীয় ও চাকুরী বঞ্চিতরা। এ বিদ্যালয়গুলো হলো বরকলের এরাবুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সিএম পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বরুনাছড়ি জোন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রকবিবছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শুকনাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৩৩ নং হাজাছড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়, ও বরকল মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
তাদের দাবি জেলা পরিষদের সংশ্লিষ্টতার অজুহাত তুলে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও প্রধান শিক্ষকরা প্রার্থীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজেদের ঘনিষ্ঠ আতœীয়কে নিয়োগ দিয়েছে। বরকলের শুকনাছড়ি এলাকার বাসিন্দা বিনিময় চাকমা জানান, শুকনাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দপ্তরী নিয়োগ পরীক্ষা ও বাছাইয়ের সময় স্থানীয় যুবক প্রিয়ন চাকমা প্রথম স্থান অধিকার করে। কিন্তু নিয়োগ দেওয়া হয় ২য় স্থান অধিকারী মিত্র চাকমাকে। মিত্র চাকমা ঐ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও সভাপতির ঘনিষ্ঠ আতœীয়। মিত্র চাকমার চাচা মন্টু চাকমা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে ৭০ হাজার টাকা দিয়ে দপ্তরী পদের চাকুরিটা নিশ্চিত করেন বলেও দাবি করেন বিনিময় চাকমা। একই অভিযোগ করে ৩৩নং হাজাছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরী পদ প্রার্থী রিকেল চাকমা। রিকেল চাকমা জানায়, তার প্রতিদ্বন্দ্বী বকুল কান্তি চাকমা স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা ও বরকল উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক সুবীর চাকমার শ্যালক। ক্ষমতার জোরে তাকে দপ্তরী পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

রিকেল চাকমার আরো অভিযোগ দপ্তরী নিয়োগের ক্ষেত্রে বয়সসীমা উল্লেখ রয়েছে ১৮-৩০ বৎসর কিন্তু বকুল কান্তি চাকমার বয়স বর্তমানে ৩৪ বৎসর। অন্যদিকে বরকল মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মেধা তালিকায় প্রথম হওয়া মনিময় চাকমাকে চাকরি না দিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মনিরুল আলম ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি মেনং রাখাইনের পছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন জনৈক মনিময় চাকমা। তিনি বলেন, আমি যখন দপ্তরী পদে দরখাস্তের জন্য ইউএনওর কাছে কাগজপত্র সত্যায়িত করতে যাই তখন ইউএনও আমাকে বলেছেন, দরখাস্ত দিয়ে লাভ নেই আমরা জ্বলন্ত চাকমাকে মনোনীত করে রেখেছি।
এদিকে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি সুরেন্দ্র চাকমা ও বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কংকনা চাকমা স্বেচ্ছাচারিতা ও স্বজনপ্রীতির আশ্রয় নিয়ে বিদ্যালয়ে দপ্তরী নিয়োগের কার্যক্রম সম্পন্ন করেছেন বলে অভিযোগ করেছে নিয়োগ বঞ্চিত পলাশ চাকমা। পলাশ চাকমা অভিযোগ করেন, রকবিবছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দপ্তরী নিয়োগ পেতে টমাস চাকমা সভাপতি ও প্রধান শিক্ষককে ১০ হাজার টাকা দিয়েছে বলে জেনেছি। অথচ টমাস চাকমা ইন্টারভিউ দেয়ার সময় নিজের জন্ম তারিখটা পর্যন্ত বলতে পারেনি। তিনি জানান, শিক্ষাগত যোগ্যতা পরীক্ষায় ভালো করার পরেও আমাকে মেধা তালিকায় ২য় রাখা হয়। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন রকবিবছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কংকনা চাকমা। তিনি বলেন, নিয়ম মেনে দপ্তরী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আমরা কারো কাছ থেকে টাকা নিইনি।

বরকল উপজেলায় দপ্তরী নিয়োগ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা নিয়ে জানতে চাইলে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মানস মুকুল চাকমা বলেন, আমরা শুনেছি দপ্তরী নিয়োগের সময়  স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও সভাপতিরা কেউ ১ লক্ষ কেউ ৫০ হাজার এভাবে নিয়েছে বলে শুনেছি। বাঙালী পাড়ায় এ হার নাকি আরো বেশি। এব্যাপারে তদন্ত করেছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ দেয়নি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এলে নিশ্চয় তদন্ত করা হবে। তবে দপ্তরী নিয়োগে বিধিমালার যথাযথ অনুসরন হয়নি বলে স্বীকার করেন উপজেলার এ প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন