প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষার আলোতে ফুটছে কোমলমতি শিশুরা

fec-image

বান্দরবানের দুর্গম রেমাক্রী ইউনিয়নে মিয়ানমার সীমান্তবর্তী ঘেঁষা সাঙ্গু রিজার্ভ এলাকায় অবস্থিত লইক্রী পাড়া। জেলা সদর থেকে এর দুরত্ব প্রায় ২শত কিলোমিটার। যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌপথ। গ্রামে যেতে সময় লাগে পুরো একদিন। লইক্রী পাড়ায় ৭০ পরিবারের সবাই ম্রো এবং ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী। সেখানের প্রত্যেকটি পরিবারের শিশুরা শিক্ষার আলোর পাশাপাশি মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। তবে চলতি বছরের শুরুতেই দুর্গম পাহাড়ি জনপদে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে স্কুল খোলেন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন’। বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শারীরিক প্রতিবন্ধি এক যুবক পাঠদানে শুরু পর পালটে যায় এলাকার চিত্র। স্বাধীনতার ৫২ বছর পর এমন উদ্যোগে খুশি নাগরিক সুবিধা এবং শিক্ষা বঞ্ছিত ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠির সম্প্রদায়ের মানুষ।

খোজ নিয়ে জানা গেছে, যেসব দুর্গম প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, ও বিদ্যুতের আলো পৌঁছানো তো দূরের কথা এখন পর্যন্ত গড়ে উঠেনি সড়ক যোগাযোগের ব্যবস্থা। সেসব এলাকার মানুষদের যাতায়াতের একমাত্রই নৌপথ ভরসা। আধুনিক সভ্যতার সকল সুযোগ সুবিধা বঞ্ছিত হয়েও দুর্গম এই জনপদের পাহাড়ি জনগোষ্ঠিরা জীবনের তাগিদে চালিয়ে যাচ্ছে বেঁচে থাকার অবিরাম সংগ্রাম। কিন্তু দুর্গম পাহাড়ি জনপদ লইক্রী পাড়ার মতন বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে ২০০৪ সাল থেকে ‘প্রাথমিক শিক্ষা প্রোগ্রাম’ চালু করেছিলেন ‘হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন’ নামে এক বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা। গত ১৯ বছরে ২২টি প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে তুলেছেন এই সংস্থাটি। এসব বিদ্যালয়ে ৯৪৮ জন ম্রো, ত্রিপুরা, মার্মা, খুমিসহ সকল সম্প্রদায়ের ছাত্রছাত্রী রয়েছেন। তাছাড়া প্রতিটি স্কুলে ২ জন করে মোট ৪৬ জন শিক্ষক অল্পবেতনে শিক্ষকতায় কর্মরত আছেন।

লইক্রি পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিবন্ধী শিক্ষক শুক্র সেন তঞ্চঙ্গ্যার সাথে কথা হয় প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, ২০২৩ সালে জানুয়ারি থেকে স্কুলে শিশুদের পড়ানো কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে শিশু শ্রেণিতে ১৪ জন, প্রথম শ্রেণিতে ৭ জন, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ২ জন, তৃতীয় শ্রেণিতে ২ জন ও চতুর্থ শ্রেণিতে ১ জনসহ মোট ২৬ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। আগামী বছর থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হবে।

শুক্র সেন তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, শিক্ষা থেকে বঞ্ছিত শিশুদের মাঝে এখন শিক্ষার আলো পৌঁছে গেছে। তারা যেন ভবিষ্যতে ভালো শিক্ষার মান ও জ্ঞান অর্জন করতে পারে। আমি চাই আমার চেয়ে তারা আরো উচ্চমানের শিক্ষা অর্জন করে উন্নত ও আধুনিক জীবন ফিরে পাক। তাই শারিরীক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও অল্পবেতনে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন বলে জানান তিনি।

বেসকারী সংস্থা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন তথ্যনুযায়ী, দুর্গম এলাকার রেমাক্রি ইউনিয়নের প্রত্যান্ত পাহাড়ি অঞ্চলে বিভিন্ন গ্রামে হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের পরিচালিত ২৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ইয়াংনাং পাড়া, বড়মদক পাড়া, ছোট মদক পাড়া, হৈকো খুমী পাড়া, ক্যমং ত্রিপুরা পাড়া, অংহ্লা পাড়া, সাজাই খুমী পাড়া, প্নেদং পাড়া, চাইহ্লাউ পাড়া ও নিয়োচিঅং পাড়াতে প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। সেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৯৪৮ জন শিক্ষার্থী প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেনী পর্যন্ত লেখাপড়া করছেন। শুধু তাই নয় দুর্গম এলাকার শিক্ষার্থীরা পঞ্চম শ্রেনী পাশ করার পর শহরে এনে এসএসসি পর্যন্ত লেখাপড়ার খরচ বহন করে আসছে এই সংস্থাটি। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ১৮জন শিক্ষার্থী অধ্যায়নরত রয়েছেন।

হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের প্রকল্প সমন্বয়কারী বিদ্যাপূর্ণ চাকমা জানান , বান্দরবান জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস থেকে বই, সিলেবাস, শিক্ষকদেরকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণসহ যাবতীয় সহযোগিতা প্রদান করা হয়ে থাকে। শুধু তাই নয় দুর্গম এলাকায় সেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিদর্শন করে শিক্ষাকদের পরামর্শ প্রদান করা হয়।

লইক্রী পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি মুইতং ম্রো কারবারি (গ্রাম প্রধান) বলেন, চলতি বছর হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন থেকে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করে দেওয়া হয়। এই স্কুল পেয়ে পাড়াবাসী খুবই খুশী এবং কৃতজ্ঞ।

তিনি বলেন, প্রতিবন্ধি যিনি শিক্ষক রয়েছেন তিনি ছাত্রদের নিয়ে নিয়মিত ক্লাস করেন। শিশুরা পড়ালেখা প্রতি আগ্রহ বাড়ায় প্রতিদিন স্কুলে যাচ্ছে। আমরা যে শিক্ষা আলো পায়নি শিশুরা যেন সেসব শিক্ষা আলোতে আলোকিত হোক সে প্রত্যশা কামনা করছি। শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া যেন চলমান থাকে সেজন্য হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন প্রতি সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেন।

সরেজমিনে দেখা গেছে, দুর্গম সীমান্তবর্তী রেমাক্রী ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের লইক্রি পাড়াতে ম্রো সম্প্রদায়ের বসবাস। পাড়ায় বাঁশের তৈরী কুঁড়েঘরের সাদৃশ্য স্কুলটি। দূর থেকে দেখা যায় আকাশে উড়ছে বাংলাদেশের লাল সবুজের জাতীয় পতাকা। সারিতে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা গাইছে আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি। সেই কুঁড়ে ঘরে উচ্ছ্বাসের কমতি নেই শিশুদের। ২৬ জন শিশু শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাচ্ছেন প্রতিবন্ধী এক যুবক। তাদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে পেরে খুশি শিক্ষকসহ পরিবার পরিজনরাও।

লইক্রী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি পড়ুয়া শিক্ষার্থীর হ্যপিং ম্রো ও নামসিং ওয়াই ম্রো বলেন, আমাদের লেখাপড়া করতে খুব ভালো লাগে। প্রতিদিন স্কুলে আসি। আমাদের স্যার ভালোভাবে পড়ালেখা শেখান। লেখাপড়া করে অনেক বড় হবো!

রেমাক্রী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুই শৈ থুই মারমা জানান, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন থানচির দুর্গম এলাকায় শিক্ষা বিস্তারে ভূমিকা পালন করছে। দুর্গম এলাকায় শিক্ষা থেকে বঞ্চিত শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলোর ছড়িয়ে দিতে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছে সংস্থাটি।

বান্দরবান জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. আব্দুল মান্নান বলেন, সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী যদি নিয়ম অনুসারে আবেদন করলে দুর্গম রেমাক্রী ইউনিয়ন এলাকার শিশুদের সরকারি প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় আনা হবে। তাছাড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে জাতীয় শিক্ষাক্রমের পাঠ্য পুস্তক সরবরাহ, শিক্ষকদেরকে প্রশিক্ষণ, বিদ্যালয় পরিদর্শন করা হয়ে থাকে বলেও জানান তিনি।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: বান্দরবান, শিক্ষার আলো
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন