মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার আহবানের মধ্য দিয়ে রাঙ্গামাটিতে শেষ হলো বৌদ্ধদের কঠিন চীবর দানোৎসব

Rangamati Kothin chibordan Pic-15.11.13

আলমগীর মানিক, রাঙ্গামাটি :

লাখো পূর্ণার্থীর শ্রদ্ধা এবং ধর্মীয় ভাবগাম্ভীয্যের মধ্যে দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব কঠিন চীবর দান রাঙ্গামাটি রাজবন বিহারে চীবর উৎসর্গের মধ্যে দিয়ে শেষ হয়েছে। রাঙামাটি রাজবনবিহারে ২ দিনব্যাপী ৪০ তম কঠিন চীবর দান উৎসবে লাখো পুণ্যার্থী অংশগ্রহণ করে। এই উৎসবকে ঘিরে গত দুইদিন রাঙামাটি শহর ছিল উৎসবের নগরী। ধর্মীয় উৎসব হলেও পুরো আয়োজনটি পরিণত হয় পার্বত্যবাসির মিলন মেলায়। রাজবনবিহারের আবাসিক প্রধান শ্রীমৎ প্রজ্ঞালংকর মহাস্থবিরের দেশনার মাধ্যমে দুইদিনব্যাপা চীবর দান উৎসবের সমাপ্তি ঘটে।

শুক্রবার দুপুর ১২ টা থেকে রাজবন বিহারের মাঠের বিশাল এলাকাজুড়ে শুরু হওয়া বর্ণাঢ্য বস্ত্র ও কল্পতরু শোভাযাত্রা মুহুর্মুহু আনন্দ ধ্বনি এবং উৎসবের জোয়ার প্রকম্পিত করে। ভোর থেকেই একেএকে জড়ো হতে থাকে পূণ্যার্থীরা।

প্রয়াত বনভান্তের শিয্যবর্গ ও অনুত্তর ভিক্ষু-সংঘ অনুষ্ঠান মঞ্চে উপস্থিত হলে ভক্তদের সাধু..সাধু..সাধু কন্ঠধ্বনিতে সমগ্র আশপাশ এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। বেলা আড়াইটায় দানযজ্ঞের প্রথম পর্বে অনুষ্ঠিত হয় ভক্তদের পঞ্চশীল গ্রহণ। পরে পর্যায়ক্রমে অনুষ্ঠিত হয় সংঘদান, অষ্ট পরিস্কার দান, বুদ্ধমুর্তি দান, ২৪ ঘন্টার মধ্যে তৈরী পূণ্যার্থীদের কঠিন চীবর দান উৎসর্গ। বিকেলে সমবেত পুন্যার্থীদের উদ্দেশ্যে ধর্মীয় দেশনা দেন বৌদ্ধধর্মীয় অন্যতম গুরু মহামতি বনভান্তের প্রধান শিষ্য শ্রী প্রজ্ঞালংকর মহাস্থবির।

বিকালে রাঙ্গামাটির রাজবন বিহার প্রাঙ্গনে বৌদ্ধ সমাবেশের মধ্য দিয়ে রাঙ্গামাটি সার্কেল চীফ রাজা দেবাশীষ রায় পার্বত্য ধর্মীয় গুরু বনভন্তের শীর্ষ মন্ডলীর কাছে এ চীবর উৎসর্গ করেন। কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠানের আজ শেষ দিনে ভিক্ষু সংঘকে চীবর উৎসর্গ করে বক্তব্য রাখেন, চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিষ্ঠার দেবাশীষ রায়, শিল্পমন্ত্রী দীলিপ বড়ুয়া। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শুভেচ্ছা বাণী পাঠ করেন, রাঙামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা, বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার শুভেচ্ছা বানী পড়ে শুনান জেলা বিএনপির সভাপতি এ্যাডভোকেট দীপেন দেওয়ান।

এসময় আরো উপস্তিত ছিলেন, রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোস্তফা কামাল, পৌর মেয়র সাইফুল ইসলাম চৌধুরী ভুট্টো, সাবেক উপমন্ত্রী মনিস্বপন দেওয়ান, বিএনপি নেতা মনীষ দেওয়ান, রাজবন বিহারের উপাসক-উপাসিকা পরিষদের কর্মকর্তাসহ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ। এ উৎসবে ২৪ ঘন্টার মধ্যে তুলা থেকে চরকায় সূতা কেটে, রং করে আগুনে শুকিয়ে সেই সুতায় তাঁতে কাপড় বুনে চীবর তৈরী করা হয়। অর্থাৎ ১৪ নভেম্বর বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টায় সুতা কাটা থেকে বুননের মাধ্যমে শুরু করা চীবর তৈরি শেষে ১৫ নভেম্বর শুক্রবার বিকাল ২টা ৫০ মিনিটে চাকমা রাজা ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায় বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের রাজবনবিহারের আবাসিক প্রধান শ্রী প্রজ্ঞালংকর মহাস্থবিরকে চীবর উৎসর্গ করার মাধ্যমে দান কার্য সম্পাদন করা হয়। এরপর শুরু হয় আনুষ্ঠানিকভাবে চীবর দান অনুষ্ঠান। এই চীবন বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরু বনভন্তেকে উৎসর্গের মধ্যে দিয়ে দানের পরিপূর্ণতা লাভ করে। এই বছর রাঙ্গামাটি রাজবন বিহারের বেইন ঘরে ২৭৩ টি চর্কা ও ১২৭ টি বেইন বসানো হয়। এই চীবর তৈরীতে দুর্গম অঞ্চলের প্রায় ৬ শতাধিক পাহাড়ি নারী অংশগ্রহণ করেন।

রাঙামাটি রাজবন বিহারে ১৯৭৭ সালে এক স্বর্গীয় অনুভূতিতে বনভান্তে বিশাখা প্রবর্তিত নিয়মে সর্বপ্রথম কঠিন চীবর দান প্রচলন করেন। এর আগে রাঙামাটি জেলার তিনটিলা বৌদ্ধ বিহারের ১৯৭৩ সালে এই কঠিন চীবর দান করা হয়। রাঙ্গামাটি রাজবন বিহারে ৪০ বছর ধরে এ নিয়মে কঠিন চীবর দান উৎসব উদযাপিত হয়ে আসছে। এই চীবর দান অনুষ্ঠানে দেশ-বিদেশের লাখেরও বেশী ধর্মপ্রাণ বৌদ্ধ নারী পুরুষের সমাগম ঘটে।

প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। উৎসবকে ঘিরে রাঙ্গামাটি রাজবন বিহার এলাকা জুড়ে বসেছে বিরাট মেলা। পরে সন্ধ্যায় সার্বজনীন প্রদীপ পূজার মধ্য দিয়ে শেষ হয় উৎসবের বর্নাঢ্য সব আয়োজন।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন