রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার: মিয়ানমারের আপত্তি খারিজ, গণহত্যার মামলা চলবে

fec-image

রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের গণহত্যার অভিযোগে গাম্বিয়ার মামলার বিরুদ্ধে যে আপত্তি তুলেছিল মিয়ানমার, সেগুলো খারিজ করে দিয়ে মামলা চলার পক্ষে রায় দিয়েছে জাতিসংঘের সর্বোচ্চ বিচারিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিস বা আন্তর্জাতিক বিচার আদালত।

গণহত্যার অভিযোগে গাম্বিয়া মামলা করার পর অভিযোগ অস্বীকার করার পাশাপাশি কয়েকটি আপত্তি জানিয়েছিল মিয়ানমার সরকার। মিয়ানমারের দাবি ছিল, গাম্বিয়ার এই মামলা করার অধিকার নেই এবং এই আদালতের বিচার করার এখতিয়ার নেই।

তবে দীর্ঘ শুনানির পর আদালতের রায়ে মিয়ানমারের সেসব আপত্তি খারিজ করে দেয়া হয়েছে। এর ফলে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে যে মামলা করেছে গাম্বিয়া, তার বিচারকার্য অব্যাহত থাকবে।

১৬ সদস্যের আদালতে ১৫-১ ভোটে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এএফপি ও রয়টার্স এই খবর দিয়েছে।

যেসব আপত্তি জানিয়েছিল মিয়ানমার:
মিয়ানমারের বক্তব্য ছিল, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় গ্রহণের কারণে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসাবে বাংলাদেশ যেহেতু আইসিজে-তে মামলা করেনি, তাই গাম্বিয়া কোনরকম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ না হয়ে মামলা করার অধিকার রাখে না।

সেই সঙ্গে দেশটি আরও আপত্তি তুলেছিল যে, গাম্বিয়া অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশনের (ওআইসি) ছায়া হয়ে মামলা করেছে। কিন্তু আইসিজের নিয়ম অনুযায়ী, কোন রাষ্ট্র মামলা করতে পারে, জোট নয়।

মিয়ানমার ও গাম্বিয়া- দুই পক্ষের মধ্যে কোন বিরোধ ছিল না বলে মামলাটি আদালতে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না বলে দাবি করেছিল দেশটি।

এছাড়া মিয়ানমার নিজেরাও জাতিসংঘের গণহত্যা কনভেনশনের ৯ অনুচ্ছেদ স্বাক্ষর করেনি বিধায় এই আদালতের মামলা গ্রহণের অধিকার নেই বলেও মিয়ানমার আপত্তি তুলেছিল।

রায়ে আদালত যা বলেছে:
মিয়ানমারের এসব আপত্তির বিষয়ে আইসিজে সভাপতি বিচারক জোয়ান ই দোনোঘুই রায়ে বলেন, গণহত্যা সনদে স্বাক্ষরকারী যেকোনো দেশ অন্য দেশের গণহত্যা প্রতিকারের স্বার্থে মামলা করতে পারে, তার অধিকার ক্ষুণ্ণ হয় না।

গাম্বিয়া কোন জোটের ছায়া হয়ে নয়, নিজের সিদ্ধান্তেই মামলা করেছে বলে আদালত নিশ্চিত হয়েছে। গণহত্যা সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসাবে দায়িত্ববোধ থেকেই গাম্বিয়া আদালতে এসেছে।

সেই সঙ্গে মামলা করার জন্য কোন প্রতিষ্ঠান বা জোটের কাছ থেকে আর্থিক বা রাজনৈতিক সহায়তা নেয়ার অধিকার গাম্বিয়ার আছে।

দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ ছিল না বলে যে আপত্তি তুলেছে, তাও খারিজ করে দিয়েছে আদালত। কারণ গাম্বিয়া ২০১৮ ও ২০১৯ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে মিয়ানমারের গণহত্যার বিষয়টি তুলে ধরে বক্তব্য দিয়েছে।

যেখানে মিয়ানমারও পাল্টা বক্তব্য দিয়েছে। মামলা করার পূর্বে মিয়ানমারের কাছে কূটনৈতিক চিঠিও পাঠিয়ে গণহত্যা বন্ধ করার দাবি জানিয়েছিল গাম্বিয়া। মিয়ানমার তার কোন জবাব দেয়নি।

সেই সঙ্গে মিয়ানমার গণহত্যা সনদ অনুসমর্থন করেনি বলে যে আপত্তি তুলেছে দেশটি, সেই প্রসঙ্গে আদালত বলেছেন, এতে আদালতের এখতিয়ার ক্ষুণ্ণ হয়না। ফলে আদালত মিয়ানমারের আপত্তি নাকচ করে দিয়েছে।

মামলার ইতিবৃত্ত:
২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মুখে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। সবমিলিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা।

এই নৃশংসতাকে গণহত্যা আখ্যা দিয়ে ২০১৯ সালের ১১ই নভেম্বর আইসিজেতে মামলা দায়ের করে আফ্রিকার মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ গাম্বিয়া।

অভিযোগে গাম্বিয়া বলেছে, রোহিঙ্গাদের উপর নৃশংস সামরিক অভিযান চালানোর মাধ্যমে ১৯৪৮ সালে গৃহীত জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ লঙ্ঘন করেছে মিয়ানমার।

দেশটি বলছে, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর সমন্বয়ে গঠিত ৫৭ জাতির সংগঠন অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্স বা ওআইসি’র পক্ষ থেকে এই অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।

গণহত্যার তদন্ত শুরু না হওয়া পর্যন্ত মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জরুরি ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানায় দেশটি।

শুনানির পর ২০২০ সালের ২৩শে জানুয়ারি একটি অন্তর্বর্তী আদেশে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দিতে আদেশ জারি করে আইসিজে।

মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার দায়ের করা মামলায় অন্তর্বর্তীকালীন রায়ে মিয়ানমারের প্রতি চারটি নির্দেশনা দেয় আইসিজে।

রাখাইনে বসবাসরত সাড়ে ছয় লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম ঝুঁকিতে রয়েছে। তাদের সুরক্ষা দেবার জন্য মিয়ানমার সরকারকে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর লাগাম টেনে ধরতে হবে। আদালত বলেছে, সেনাবাহিনী কিংবা অন্য যে কোন ধরণের নিরাপত্তা বাহিনী যাতে গণহত্যা না চালায় কিংবা উস্কানি না দেয় সেজন্য সব ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
রোহিঙ্গা গণহত্যা সংক্রান্ত যেসব অভিযোগ এসেছে, সে সংক্রান্ত তথ্য-প্রমাণ সংরক্ষণ করতে হবে
রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা দেবার জন্য মিয়ানমার কী ধরণের ব্যবস্থা নিয়েছে সে সংক্রান্ত প্রতিবেদন আগামী চারমাসের মধ্যে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের কাছে জমা দিতে হবে। এরপর প্রতি ছয়মাসে একটি করে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। এসব প্রতিবেদন গাম্বিয়ার কাছে তুলে ধরা হবে।
আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে মামলা করার প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল রোহিঙ্গাদের ওপর যে নির্যাতন হচ্ছে, সে ব্যাপারে বিশ্বব্যাপীকে কিছু করার জন্য তাগিদ দেয়া।

আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে ক্ষুদ্র দেশগুলোর মধ্যে গাম্বিয়া অন্যতম।

পশ্চিম আফ্রিকার মুসলিমপ্রধান এই দেশটিই রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগ এনে জাতিসংঘে সর্বোচ্চ আদালত ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস বা আইসিজে-তে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে।

গাম্বিয়ার পরিচিতি:
দেশটির আয়তন বাংলাদেশের ১২ ভাগের এক ভাগ এবং দেশটির মোট জনসংখ্যা মাত্র ১৯ লাখ। গাম্বিয়ার জনসংখ্যার ৯৫ শতাংশ সুন্নি মুসলিম।

১৯৬৫ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে গাম্বিয়া। ১৯৮২ সালে সেনেগালের সাথে একত্রিত হয়ে ‘সেনেগাম্বিয়া’ নামের একটি কনফেডারেশন করা হয়। কিন্তু ১৯৮৯ সালে সে কনফেডারেশন ভেঙ্গে যায়।

১৯৯৪ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেন লেফট্যানেন্ট ইয়াহিয়া জামেহ্। তিনি দীর্ঘ ২২ বছর দেশ শাসন করেন।

২০১৫ সালে গাম্বিয়াকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করেন দেশটির তখনকার প্রেসিডেন্ট।

সূত্র: বিবিসি
Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: গণহত্যা, বিচার, মামলা
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন