সেন্টমার্টিন দ্বীপে মালয়েশিয়ায় মানবপাচারে ১৫ সিন্ডিকেট

মানবপাচার

টেকনাফ প্রতিনিধি:
স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়ায় যাত্রা। উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়ে নিজের জীবনকে এক অনিশ্চয়তার হাতে তুলে দিয়ে এভাবেই অবৈধভাবে সাগর পথে পাড়ি জমাচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। আর এসব মানব পাচারের কাজে জড়িত মূল হোতারা বরাবরই থেকে যাচ্ছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

রাজনৈতিক ছত্রছায়া, স্থানীয় প্রভাব আর প্রশাসনকে ম্যানেজ করে বছরের পর বছর চলছে সাগর পথে মানবপাচার। দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এবং ভৌগলিকভাবে সুবিধাজনক স্থানে দ্বীপটির অবস্থান হওয়ায় মানবপাচারের রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বিগত কয়েক বছরও সাম্প্রতিক সময়ে নৌ-বাহিনী কর্তৃক মালয়েশিয়াগামী বড় বড় নৌযান শত শত আদমসহ সেন্টমার্টিনদ্বীপের ছিরাদ্বীপের পাশ থেকে আটক করা হয়েছিল।

দ্বীপটি পর্যটন এলাকা হওয়ায় দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মালয়েশিয়াগামী আদম পর্যটক সেজে সেন্টমার্টিন অবস্থান করলেও দ্বীপের সংশ্লিষ্ট দালালদের তত্ত্বাবধানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে সাগরপথে মালয়েশিয়া পাঠিয়ে দেওয়া হতো। এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও জনপ্রতিনিধিদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

এদিকে থাইল্যান্ড গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেলেও আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে সেন্টমার্টিন ও মিয়ানমার সীমান্ত ব্যবহার করে ১৫ সিন্ডিকেট পুরো মালয়েশিয়া মানবপাচার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। দূরদূরান্ত থেকে আসা বিভিন্ন ট্রলারে থাকা যাত্রীদের নিয়ন্ত্রণের কাজ করত এ সিন্ডিকেট।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, সেন্টমার্টিন মাঝেরপাড়ার মৃত জাফর আহমদের ছেলে আবুল কালাম (কালাইয়া) (৩৫), পূর্বপাড়ার খলিলুর রহমানের ছেলে আবু তালেব মাঝি, লাল মিয়ার ছেলে আবদুর রহমান, করিম উল্লাহর ছেলে ইসমাইল মাঝি, জাফর আহমদের ছেলে নজির মাঝি (প্রকাশ দালাল) (৪০), পশ্চিমপাড়ার ছৈয়দ কাশিমের ছেলে ফয়েজুল ইসলাম (৩৫), গলাচিপার সিরাজুল ইসলামের ছেলে ছৈয়দ মাঝি, মৃত আমির আহমদের ছেলে রশিদ আহমদ, ডেইল পাড়ার আবদুল করিমের ছেলে হাফেজ আহমদ, কোনাপাড়ার মো: হোছনের ছেলে হাফেজ আহমদ ও আজিম উল্লাহ। দ্বীপের ৬নং ওয়ার্ডের বশির মেম্বারের মেয়ের জামাই বামাইয়া ফয়েজ কামাল (২৭)তার ভাই কবির আহমদ ও বার্মার ডংখালীর আলী আহমদের ছেলে মো: রফিক, পশ্চিম পাড়ার আবদুল আলীর ছেলে কবির আহমদ (৪৮), ৫নং ওয়ার্ডের শামসু মেম্বার ও ৯নং ওয়ার্ডের আবদুর রব মেম্বার।মানবপাচার সংক্রান্ত বিষয়ে প্রশাসন যখন চিরুণী অভিযান শুরু করেছে। তখন স্থানীয় দালালেরা এলাকা ছেড়ে পালাচ্ছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, শুধু মালয়েশিয়া নয়, থাইল্যান্ড কিংবা ইন্দোনেশিয়া যাত্রা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে সেখানে যাচ্ছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের হাজার হাজার স্বপ্নপ্রত্যাশী মানুষ। ভালো উপার্জনের আশায় এসব লোকজন বিক্রি করে দিচ্ছেন ঘরবাড়ি, জমিজমা। টাকা তুলে দিচ্ছেন দালালদের হাতে। আর এই কাজটি করতে গিয়ে গরিব, দিনমজুর, মধ্যবিত্ত মানুষেরা মোকাবিলা করছেন সাগরের উত্তাল ঢেউ। প্রবল বৃষ্টি। ভয়ঙ্কর প্রাণী। জেল খাঁটছেন। অনেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। পথে পথে ঘুমাচ্ছেন। না খেয়ে পার করছেন দিন। আর যারা অর্ধাহারে-অনাহারে ওইসব দেশে পৌঁছেন তাদেরও শান্তি নেই।

স্বল্প খরচে বিদেশ পাড়ি দিয়ে এসেব লোকজনকে করতে হয় মানবেতর জীবনযাপন করছেন। হাজারো স্বপ্ন নিয়ে দালালদের হাতে সব কিছু তুলে দিয়ে মালয়েশিয়া যেতে গিয়ে তাদের স্বপ্নভঙ্গ হলেও ধরা পড়ছে না মানবপাচারের কাজে জড়িত মূল হোতারা। রাজনৈতিক ছত্রছায়া, স্থানীয় প্রভাব আর পুলিশ প্রশাসনকে ম্যানেজ করে বছরের পর বছর চলছে বিদেশে লোক পাঠানোর নামে এই মানবপাচার। এই কাজকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ১৫ সিন্ডিকেট। নিঃস্ব করছে তারা স্বপ্নপ্রত্যাশী মানুষদের। আর এ জন্য গোপনে বেছে নেয়া হয়েছে সমুদ্র রুটটি।

ভুক্তভোগীরা জানান, সাগর পাড়ি দিয়ে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড কিংবা ইন্দোনেশিয়া যাওয়ার জন্য একজন লোকের কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। আর এই কাজটির জন্য তারা স্থানীয়ভাবে খোঁজ করে বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা আদম পাচারকারীদের। যাদের সঙ্গে আবার যোগাযোগ রয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রামের অনেক ট্রাভেলস প্রতিষ্ঠানের। কেউ যদি এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যেতে চান, তাহলে তারা টেকনাফে স্থানীয় এজেন্ট হিসেবে কাজ করা সিন্ডিকেটের সঙ্গে আবার যোগাযোগ করিয়ে দেয়। বেশির ভাগ লোকই মালয়েশিয়া পৌঁছে যায়।

বর্তমানে মালয়েশিয়ায় দিন-রাত কাজ করে প্রতি মাসে দেড়-দুই হাজার রিংগিত আয় হয়, যা বাংলাদেশের ২৫-৩০ হাজার টাকার সমান। অনেক সময় বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে আসা শ্রমিকরা দিনের বেলায় কাজ করে নিজের বাসায় ফিরতে পারে না। তাই তারা সে দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পাহাড়ে রাত কাটান।

তবে সেখানে পৌঁছার পর থাইল্যান্ডের নৌ ও কোস্ট গার্ড বাহিনীর হাতে আটক হন অনেকে। যারা ধরা পড়েন তাদের ওপর শুরু হয় নির্যাতন। থাইল্যান্ড কোস্টগার্ড হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ইঞ্জিনবিহীন নৌকায় বাংলাদেশীদের তুলে সমুদ্রে বাসিয়ে দেয়। সাগরে ভেসে থাকার পর এসব লোকজনের ভাগ্যে মৃত্যু ছাড়া কিছুই জোটে না। এসব স্থান থেকে যান্ত্রিক ফিশিং বোট দিয়ে লোকজন সাগর পাড়ি দিচ্ছে।

মালয়েশিয়াগামী আবদুল মালেকের স্ত্রী ছখিনা খাতুন ও বশির আহমদের স্ত্রী লাইলা বেগম বলেন, ‘আমরা কানের দুল, নাকের ফুল ও বিভিন্ন প্রকারের আসবাবপত্র বিক্রয় করে স্বামীকে মালয়েশিয়া যাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর খবরে তাদের মাথায় সাত আসমান ভেঙে পড়ে।’ বর্তমানে অনেক কষ্টে দিন কাটছে তাদের। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ।

অনুসন্ধানে একজন দালাল চক্রের সক্রিয় সদস্য জানান, থাইল্যান্ড সীমান্ত গিয়ে সেখানে দালাল চক্রের কিছু সদস্য রয়েছে। তারা থাইল্যান্ড থেকে মালয়েশিয়া সীমান্ত পারাপার করতে জনপ্রতি ৭০-৮০ হাজার টাকা নেয়। তাদের বিরুদ্ধে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার কথা বলে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ করেছেন প্রতারণার শিকার অনেকেই মামলা করেছে।

টেকনাফস্থ ৪২ বিজিবি অধিনায়ক লে. কর্নেল আবুজার আল জাহিদ হাসান বলেন, ‘অবৈধ ঝুঁকিপূর্ণ পথে মালয়েশিয়া পাড়ি জমানো থেকে লোকজনদের রক্ষা করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এই জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সামাজিক ও রাজনৈতিক লোকজনদের সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।’

একই রকম অভিমত ব্যক্ত করেছেন টেকনাফ থানার ওসি আতাউর রহমান খোন্দকার । তিনি বলেন, ‘মানবপাচার প্রতিরোধে এর সাথে জড়িত বেশ কয়েকটি গ্রুপকে চিহ্নিত করার কাজ চলছে। ইতিমধ্যে তাদের গ্রেফতারে পুলিশ অভিযানও চালিয়েছে। এরপরও বলবো মানবপাচার প্রতিরোধে যারা মালয়েশিয়া যাওয়ার লোভে নিজের প্রাণকে ভাগ্যের হাতে তুলে দিয়ে নৌকায় করে সমুদ্র পথে রওনা দেয় তাদের আরো সচেতন হতে হবে। তাদের সচেতনতাই হচ্ছে মানবপাচার প্রতিরোধের অন্যতম উপায়।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন