সেলিমের জন্য শোকগাথা

65007_502619159760350_251704044_n

১৯৯১ সালের ২৩ জুলাই পার্বত্য চট্টগ্রামে ঘটে যাওয়া এক মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড অবলম্বলে রচিত ছোটগল্প
সৈয়দ ইবনে রহমত:
সেলিম মারা গেছে চারদিন আগে। কিন্তু শোক এখনো থামছে না। তার স্মৃতি ভুলতে পারছে না কেউ। বাড়িতে মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ চলছেই। থেমে নেই বাবার দীর্ঘশ্বাসও। সহপাঠীরা মৃত্যুর পরেরদিন তার শোকে ক্লাস করেনি। এরপর থেকে ক্লাস করছে কালো বেজ ধারণ করে। আজ তারা বন্ধুর আত্মার মাগফিরাত কামনার জন্য মিলাদ-মাহফিল আয়োজন করেছে। মিলাদ হবে বিকালে। তার আগে স্কুলের ছাত্র-শিক্ষক সবাই সেলিমের কবর যিয়ারত করেছে। তারপর এসেছে মাকে শান্তনা দিতে। তার পরিবারকে শান্তনা দিতে। এসেই শুনছে- সেলিমের মায়ের আর্তনাদ। মা আর্তনাদ করে বলছেন, কাল রাতে সেলিম এসেছিল। এসে আমাকে বলেছে- মা, তুমি আর কেঁদ না। তুমি কাঁদলে আমার কষ্ট হয়। খুব কষ্ট হয়। মা, কপালটা ছড়ার পানিতে পড়ে আছে। বাবাকে বল এনে দিতে। অশ্রুসিক্ত চোখ মুছে বাবা জানালেন, রাতে সেলিমকে স্বপ্নে দেখেছে। আর সকাল থেকে সে কথা বলে বলেই কাঁদছে। আর অনুরোধ করছে সেলিমের কপালের হাড়টা এনে দিতে। কিন্তু কিভাবে আনব? এখন তো পাহাড়ে যাওয়া যায় না। গেলেও বিডিআর কিংবা আর্মি নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু তারা কি যাবে একটা হাড়ের জন্য?

আসলে সেলিম মারা গেছে, এটা বলা ঠিক না। কারণ তার মৃত্যুটা স্বাভাবিক ছিল না। ঘাতকেরা তার জীবনটা কেড়ে নিয়েছে। কেড়ে নিয়েছে নির্মমভাবে। নির্মমতার তান্ডবে বিকৃত হয়েগিয়েছিল তার নিষ্পাপ কিশোর মুখছবিটা। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল কপালের একটা অংশ। ঝাঁঝড়া হয়ে গিয়েছিল বুকটাও। তাই বিকৃত-অর্ধবিকৃত সাতটি লাশের মধ্যে কোনটা কার তা নিয়ে ভাবনায় পড়তে হয়েছিল স্বজনদের। সেলিমের লাশ নিয়েও দ্বিধায় পড়েছিলেন তার বাবা। গায়ের জামা দেখেও তিনি ছেলেকে চিনতে পারছিলেন না । রক্তে ভিজে সেটা একাকার। পুরনো মলিন সাদা শার্ট, রক্ত শোষণ করে ধারণ করেছে ভিন্ন রং। একই সাথে শুয়ে আছে সাত জন। রক্তে ভেজা সবার গায়ের জামার রং প্রায় এক। তাই কোনটা তার প্রাণপ্রিয় সেলিমের দেহ, সেটা নিয়ে ভাবতে হয়েছিল। হ্যাঁ, ভাবতে হয়েছিল তাঁরই রক্ত থেকে জন্ম নেয়া আদর আর ভালবাসায় সিক্ত প্রথম সন্তানকে চিনতে! সদ্য মাংস পিন্ডে পরিণত হওয়া টগবগে কিশোরের শরীরটা দেখে কোনভাবেই চিনতে পারছিলেন না। অবশেষে চিনলেন। চিনলেন পড়নের লুঙ্গির একটা অংশ দেখে। কারণ এটা তাঁর নিজেরই লুঙ্গি। পুরনো হয়ে গিয়েছিল। তাই ফেলে রেখেছিলেন। সকালে বাবার পুরনো লুঙ্গিটাই পড়ে গিয়েছিল সেলিম।

সেলিমের মায়ের কান্না দেখতে দেখতে ভাবনার অতলে হারিয়ে যায় সহপাঠী আজাদ। আচ্ছা , সেলিমকে জীবন দিতে হলো কেন, তার কি অপরাধ ছিল- এসব নিয়ে ভাবছে। কিন্তু কোন কূল পাচ্ছে না। ৭ম শ্রেণীর মেধাবী ছাত্র সেলিমের ছবিটা বারবার চোখে ভাসে। উদ্যমী মুখ। তর্কে কখনো হার মানতে চায় না। ক্ষিপ্র গতির ফুটবলার। প্রাণবন্ত হাসিখুশি মানুষ। এইতো সেলিমের পরিচয়। কিন্তু এর মধ্যে দোষটা কোথায়? যে দোষের জন্য তাকে এমন নৃশংসভাবে জীবন দিতে হবে? হ্যাঁ, আজাদের মনে একটা অপরাধ ধরা পড়ে। সেলিম দরিদ্র পরিবারের সন্তান। তিন বেলা খাবারের নিশ্চয়তা নেই। তারপরেও সে লেখাপড়া করে। বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখে। হয়ত এটাই তার অপরাধ। আর এই অপরাধেই তাকে জীবন দিতে হয়েছে।

আজাদের চোখে ভাসে সেদিনের স্মৃতি। যেদিন শেষবারের মত ছুটির পর একসাথে স্কুল থেকে বের হয়েছিল তারা। পবিত্র আশুরা উপলক্ষে স্কুল বন্ধ দেয়া হয়েছে। বন্ধ পেয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা বেশ খুশি। বন্ধে কে কি করবে তাই নিয়ে কথা বলছিল সবাই। কেউ বলছে বাসায় বসে পুরনো পড়া রিভাইজ করবে। কেউবা যাবে আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে। এমনই সাদা-মাঠা পরিকপনা সবার। কিন্তু সেলিম বলছিল অন্য কথা। বন্দের দিনটা সে কাজে লাগাবে। সে যাবে পাহাড়ে। পাহাড় থেকে বাঁশ কেটে আনবে। বাঁশ বিক্রির টাকা দিয়ে স্কুলের বকেয়া বেতন আর পরীক্ষার ফিস পরিশোধ করবে। এরপর কিছু বাকি থাকলে কিনবে খাতা-কলম। কারণ আশুরার বন্দের নোটিশের সাথে প্রথম সাময়িক পরীক্ষার নোটিশও দেয়া হয়েছে। সেখানে পরীক্ষা শুরুর আগেই বকেয়া বেতন আর পরীক্ষার ফিস পরিশোধ করার তাগিদ দেয়া হয়েছে। কিন্তু তার বাবার পক্ষে তো এতগুলো টাকা একসাথে দেয়া সম্ভব না। তাই সে নিজেই যাবে তার খরচ যোগাতে।

পরেরদিন অর্থাৎ ২৩ জুলাই, ১৯৯১। দুপুরের দিকেই পাহাড় থেকে ভেসে এলো গুলির শব্দ। একটা কিংবা দুইটা নয়, ভেসে এলো ঝাঁকে ঝাঁকে গুলির শব্দ। গুলির শব্দে আতংকিত হয়ে উঠল এলাকার মানুষ। শুরু হলো ছুটাছুটি। বিশেষ করে যাদের আত্মীয়-স্বজন পাহাড়ে গাছ কিংবা বাঁশ কাটতে গিয়েছিল তারা অস্থির হয়ে পড়ল। কি ঘটছে তা জানার জন্য সবাই অস্থির। নিকটবর্তী বিডিআর ক্যাম্পে খোঁজ নিয়েও পাহাড়ের খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই ভয় আর উৎকণ্ঠায় সবাই হতবিহ্বল । তবে বেশি সময় তাদের অপেক্ষা করতে হয়নি। ঘন্টাখানিক পরেই খবর পাওয়া যেতে থাকল। পাহাড় থেকে ছুটে আসতে থাকল মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষ জন। তারাই খবর নিয়ে আসছে। শান্তিবাহিনী আক্রমণ করেছে। নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে পাহাড়ে যাওয়া মানুষগুলোর উপর- এই খবর দিচ্ছিল সবাই। কিন্তু বাস্তবে কি হয়েছে তা নিয়ে এক একজন এক এক কথা বলছিল। এর মধ্যেই কয়েকজনকে পাওয়া গেল, যারা ঘটনা নিজ চোখে দেখে এসেছে। আরো নির্ভরযোগ্য একজন পাওয়া গেল, নির্ভরযোগ্য কারণ তার বাঁ পায়ে গুলির চিহ্ন রয়েছে। তবে গুলিটা বেশি ভিতরে ঢুকেনি। তাই কোন রকমে পালিয়ে আসতে পেরেছে। সেই জানাল, সেলিমসহ তারা পাঁচজন একসাথে ছিল। বাঁশ কাটা শেষ। যার যার আঁটি বেঁধে তারা ফিরে আসার জন্য তৈরি হয়েছে। এসময় সেলিম বলল, তার তৃষ্ণা পেয়েছে। এটা বলেই সে নীচে ছড়ায় পানি খেতে গেল। এরপরেই শুরু হলো গুলি। প্রথমেই এলমজি’র ব্রাশ ফায়ার। বিরামহীন চলতেই থাকল। এর মধ্যেই সে ছুটে পালিয়েছে। কার গায়ে গুলি লেগেছে আর বাকিরা কে কোন দিকে গেছে তার সে কিছুই জানে না। নিজের পায়ে যে গুলি লেগেছে এটাও সে বুঝতে পেরেছে অনেক পরে।

এভাবেই কাটল আরো কিছুক্ষণ। তারপর আস্তে আস্তে জানা গেল অনেক কিছুই। প্রতিদিনের মত সেদিন সকালেও শতাধিক খেটে খাওয়া মানুষ পাহাড়ে গিয়েছিল। সেই অসহায় মানুষগুলোর উপরই হিংস্র আক্রমণ চালিয়েছে শান্তিবাহিনী। হত্যা করেছে অনেককে। কিন্তু কত জন নিহত হয়েছে তা নিশ্চিত হওয়া গেল না। কিন্তু কেন এই আক্রমণ, তা বুঝতে পারল না কেউ। কারণ একদিকে শান্তিবাহিনীর স্ব-ঘোষিত অস্রবিরতি চলছে। অন্যদিকে যারা পাহাড়ে যায় তাদের কাছ থেকে চাঁদাও নিচ্ছে প্রতিদিন। তারপরেও এই হত্যাকান্ড কেন? এই নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলল। কিন্তু উত্তর পেল না কেউ। অবশেষে কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীসহ গ্রামের সাহসী কিছু লোক গেল বিডিআর জোয়ানদের সাথে। সন্ধ্যার দিকে তারা ঘটনাস্থল থেকে সেলিম, জৈনদ্দিনসহ একে একে বয়ে আনল সাত জনের লাশ। সন্ধ্যার ঘন কালো অন্ধকারের সাথে মিশে গেল লাশের মিছিল। রক্তাক্ত লাশের মৌন মিছিল আর স্বজনদের আহাজারী আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তুলল। একেতো দশই মহররমের শোক তার সাথে যুক্ত হলো এই করুণ ট্র্যাজেডি। নির্বাক হয়ে গেল আজাদ, নির্বাক হয়ে গেল তার বন্ধুরা। নির্বাক হয়ে গেল এলাকার ছোট-বড় সব মানুষ।

পরবর্তী ঘটনাগুলো খুব স্বাভাবিক। সেগুলো ঘটলও খুব দ্রুত। রাতেই সব লাশ দাফন করা হলো। কবরগুলো দেয়া হলো এক সারিতেই। পরেরদিন আহসানপুর গোরুস্থানে দেখাগেল পাশাপাশি সাতটি নতুন কবর। দিনের আলোতে কবরের উপরের মাটি যেন জ্বলজ্বল করছে। কবরের উপর মাটির ঢিবিগুলোর দিকে তাকিয়ে আজাদের মনে হলো, কবরের নতুন মাটিগুলো কিছু একটা যেন বলতে চায়। কি যেন একটা নতুন বার্তা শুনাতে চায় জীবীতদের। কিন্তু সে বার্তা যে আসলে কি, তা বুঝতে পারে না আজাদ। তাই সে মনে দ্বিধা নিয়েই ভাবে, আজ আর সেলিমের কোন স্বপ্ন নেই। প্রয়োজন নেই টাকার। তাকে পরীক্ষাও দিতে হবে না, ফিসও দিতে হবে না। সামান্য পড়ালেখার খরচ যোগানোর জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যেতে হবে না পাহাড়েও। তার পাশে আরো যারা শুয়ে আছে, তারাও আজ উঠে গেছে সকল প্রয়োজনের উর্ধ্বে। এভাবেই একদিন সবার প্রয়োজনই ফুরিয়ে যাবে। এমনকি তার নিজের প্রয়োজনও। আজ সেলিমের কপালের জন্য মায়ের আকুতি দেখে আবার ভাবনায় পড়ে আজাদ । সে কি তার ভাবনার কথা বলবে? তার কি এটা বলা উচিৎ? তার উপলব্দির কথা শুনে, মায়ের মন কি শান্তনা পাবে? নাকি এটা তারই একান্ত ভাবনা? আর অন্যদের বিষয়টা আলাদা? না, সে তার ভাবনায় স্থির হতে পারে না।

আজাদের এলোমেলো ভাবনা চলতেই থাকে। একই সাথে চলতে থাকে মায়ের আর্তনাদ। নাড়ীছেড়া ধন হারিয়ে পাগলীনী মা, যখন যা ইচ্ছা তাই বলছে। গোরের মধ্যে যা ইচ্ছা তাই করছে। কখনো স্কুল থেকে আসা ছেলেদের মধ্যে খুঁজছে নিজের সন্তানকে।

জিজ্ঞেস করছে বাবা, তোমরা আমার সেলিমকে দেখেছ?

কখনো আবার সমবয়সী কারো মুখে হাত বুলিয়ে বুঝতে চাইছে, এটাই তারা সেলিম কিনা। ক্লান্ত হয়ে কখনো বসে পড়ছে, বসে বসে যা ইচ্ছ বলে যাচ্ছে আপন মনে, সেলিম আমার সাথে রাগ করে লুকিয়ে আছে। কয়দিন ধরে বাড়িতে আসে না। ভাতও খায় না। আমিতো ভাত নিয়ে বসে আছি। বিড়ালে খেয়ে ফেলতে চায়। কতক্ষণ পাহাড়া দিয়ে রাখব? নষ্ট হয়ে যাবেতো। আবার বলছে, কাল সেলিম এসেছিল। আমাকে বলেছে- মা, আমার কপালটা ছড়ার পানিতে পড়ে আছে। তুমি বাবাকে বল, এনে দিতে।

আমিতো সকাল থেকেই বলছি। কিন্তু তার বাবাতো যায় না। এই জন্যই তো রাগ করে আছে। বাবা, তোমরা কেউ যাবে? যাবে তোমরা, আমার সেলিমের কপালটা এনে দিতে। —

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন