কক্সবাজারের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা

fec-image

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজীবনের স্বপ্ন ছিল বাংলার স্বাধীনতা ও বাঙালির জাতিসত্তার প্রতিষ্ঠা। শৈশব-কৈশোর জীবন থেকে তিনি এই আদর্শ নিয়েই বড় হয়ে উঠেন। তিনি নিজেই নিজেকে প্রস্তুত করে তোলেন।

রাজনৈতিক জীবনে বঙ্গবন্ধু অনেক জেলায় সফর করেন তা তার আত্মজীবনী পড়লে জানা যায়। আওয়ামী লীগের পুনর্গঠন এবং দেশকে নিজের মতো করে বুঝতে তিনি পুরো বাংলাদেশ চষে বেড়িয়েছেন। সরকারি-বেসরকারিভাবে গ্রামাঞ্চলে চষে বেড়িয়েছেন তিনি। এর অংশ হিসেবে অসংখ্যবার কক্সবাজার সফর করেন জাতির পিতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর রাজনৈতিক জীবনে কক্সবাজার আসার অনুসন্ধানই এ লেখার উপজীব্য বিষয়। শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর রাজনৈতিক জীবনে প্রথম কক্সবাজার সফর করেন ১৯৫৪ সালে, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের নির্বাচনী প্রচারণা কার্যক্রমে। রাষ্ট্রভাষা প্রশ্ন ও পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দাবিসহ ২১ দফার ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত যুক্তফ্রন্ট এ নির্বাচনী প্রচারণা কাজে অংশ হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, এম এ আজিজকে সাথে নিয়ে কক্সবাজারে আসেন। সাথে ছিলেন পল্লীকবি জসিম উদ্দীন ও শিল্পী আব্বাস উদ্দিন আহমদ, জহুর আহমদ চৌধুরী। নির্ধারিত সময়ে কক্সবাজার মহকুমা আওয়ামী মুসলিম লীগের আহ্বায়ক আফসার কামাল চৌধুরী, যুক্তফ্রন্টের আহ্বায়ক গোলাম মহিউদ্দীন চৌধুরী মোক্তার ও কৃষক শ্রমিক পার্টির আহ্বায়ক এডভোকেট বদিউল আলম চৌধুরীর উদ্যোগে এ নির্বাচনী জনসভার আয়োজন করা হয়। কক্সবাজার শহরের পানবাজারস্থ দক্ষিণের খালি জায়গায় আয়োজিত জনসভায় মাওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর শোষণ থেকে বাঁচার জন্য মুসলিম লীগের কবর রচনা করতে যুক্তফ্রন্ট প্রার্থীদের জয়যুক্ত করে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য রাখেন। আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও অন্যান্য রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দাবি করেন এবং আগামী নির্বাচন স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে পরিচালনার দাবি জানান তিনি।

১৯৫৫ সালের ৩-৪ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগের ইউনিট পর্যায়ে বিস্তৃতি এবং ২১ দফার বাস্তবায়ন কর্মসূচি সপ্তাহ পালনের প্রচারাভিযানে অংশ নিতে চকরিয়া ও কক্সবাজারে জনসভায় যোগদান করেন।

১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের ইউনিট পর্যায়ে বিস্তৃতি, ২১ দফা বাস্তবায়ন, বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি, মুসলিম লীগ সরকারের আট বছরে প্রতিষ্ঠিত জালিয়াতিযুক্ত অপ-প্রশাসনের দৌরাত্ম্য, ক্ষতিপূরণ ছাড়াই জমিদারি ব্যবস্থা বিলুপ্তকরণ, সকল রাজনৈতিক বন্দীদের নিঃশর্ত মুক্তি এবং পাকিস্তানের শোষণ নির্যাতন থেকে বাঁচাতে জনগণকে সচেতন করে তুলতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ জেলা ও মহকুমা সফর করার সিদ্ধান্ত নেন। নির্দেশনা মোতাবেক ১৯৫৫ সালের ৩ জুন চকরিয়া বিমানবন্দরস্থ ঘনশ্যাম বাজারে ২ হাজার জনের এক বিরাট জনসভার আয়োজন করা হয়। চট্টগ্রাম আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি শেখ মোজাফফর আহমদের (১৯০৮-১৯৭১) সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (আওয়ামী মুসলিম লীগ), পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানসহ বক্তারা পাকিস্তান মুসলিম লীগ সরকারের আট বছরে প্রতিষ্ঠিত জালিয়াতিযুক্ত অপ-প্রশাসনের দৌরাত্ম্য, ক্ষতিপূরণ ছাড়াই জমিদারি ব্যবস্থা বিলুপ্তকরণ, পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলার স্বীকৃতি দান, সকল রাজবন্দীদের নিঃশর্ত মুক্তি এবং জননিরাপত্তা অধ্যাদেশ বাতিল করার দাবি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন। তারা আওয়ামী মুসলিম লীগের ব্যানারে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যুক্তফ্রন্ট পার্টির ‘২১-পয়েন্ট’ কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য সংগ্রাম অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান। সভায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান, চট্টগ্রাম আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ আজিজ, চট্টগ্রাম আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রচার সম্পাদক চকরিয়ার হারবাং নিবাসী ডা. আনোয়ার হোসেন, কক্সবাজার মহকুমা আওয়ামী মুসলিম লীগের সম্পাদক গোলাম মহিউদ্দীন চৌধুরী, আজিজুর রহমান প্রমুখ। ১৯৫৫ সালের ৪ জুন কক্সবাজার মহকুমা আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক বিরাট জনসমাবেশে যোগদান করেন বঙ্গবন্ধু। কক্সবাজার পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে কক্সবাজার মহকুমা আওয়ামী লীগ নেতা মৌলভী আবদুস সালামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেল লাইন নির্মাণ, সকল নিরাপত্তা বন্দীদের নিঃশর্ত মুক্তি, পূর্ব বাংলার আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, কক্সবাজারের লবণের উৎপাদকদের উপর লবণের কর অবিলম্বে বিলুপ্তকরণ, কক্সবাজারে একটি কলেজ ও প্রযুক্তি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, তামাক উৎপাদনকারীদের উপর আরোপিত কর হ্রাস, পতেঙ্গা, হালিশহর, কুতুবদিয়া, কক্সবাজার ও চেরিংগাসহ অন্যান্য এলাকার যে সব জায়গা থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে তার জায়গার লোকদের ক্ষতিপূরণ দেয়া, প্রাথমিক শিক্ষকের নির্ধারিত বেতন বৃদ্ধি এবং পূর্ব বাংলায় সংসদীয় সরকার পুনঃপ্রবর্তনসহ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত হয়।

১৯৫৬ সালে শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতি দমন ও ভিলেজ এইড দপ্তরের মন্ত্রী থাকাকালে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন পর্যটনকে ঢেলে সাজাতে সমুদ্র তীর সংলগ্ন বাহারছড়া এলাকায় ১৩ জন বিদেশি পর্যটককে নিয়ে সাগরিকা নামে কক্সবাজারে প্রথম পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণ করেন। ওই সময় শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক পার্টি দলীয় এমএলএ এডভোকেট ফিরোজ আহমদ চৌধুরী, চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ আজিজ, কক্সবাজার মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি আফসার কামাল চৌধুরী, মহকুমা সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন মোক্তার, সাংগঠনিক সম্পাদক জালাল আহমদ চৌধুরী, কক্সবাজার টাউন কমিটির চেয়ারম্যান আবদুস সালাম, আজিজুর রহমান প্রকাশ লাল আজিজ প্রমুখ।

১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ সদস্য ও পূর্ব পাকিস্তান টি-বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে বনজ সম্পদ রক্ষা ও স্বাস্থ্যকর নগরী হিসেবে কক্সবাজারকে একটি শক্তিশালী পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তুলতে কালো সোনা খ্যাত ইনানী এবং কক্সবাজার আওয়ামী লীগের শ্রমিক সমাবেশে অংশগ্রহণ করতে। ১৯৫৮ সালের ১৫ জানুয়ারি বুধবার কক্সবাজার স্টেডিয়ামে কক্সবাজার মহকুমা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি গোলাম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে ৪০০ শ্রমিকের অংশগ্রহণে এক শ্রমিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। শ্রমিক সমাবেশে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান মুসলিম লীগ এবং নিজাম-ই ইসলামির নেতাকর্মীদের সমালোচনা করে বলেন, মুসলিম লীগ ও নিজাম-ই ইসলামির নেতাকর্মীরা পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থের কথা চিন্তা না করে শাসকগোষ্ঠীর তোষামোদিতে ব্যস্ত। তাই তাদের তথাকথিত নেতাদের কথা বিশ্বাস করবেন না। সভায় আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করে তুলতে আওয়ামী লীগে যোগদান করার অনুরোধ জানান এবং আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সকল প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার এবং ভোট প্রদানের আহ্বান জানান।

কক্সবাজার মহকুমা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি গোলাম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় পূর্ব পাকিস্তান সরকারের শ্রম ও শিল্প মন্ত্রী এম. মনসুর আলী, চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি এম এ আজিজ, প্রচার সম্পাদক ডা. আনোয়ার হোসেন, কক্সবাজার মহকুমা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক মোহাম্মদ রশিদসহ মহকুমা ও জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা বক্তৃতা দেন। ওই সমাবেশে মৌলভী আবদুল জলিলকে সভাপতি করে মহকুমা আওয়ামী লীগের কমিটিও গঠন করা হয়।

১৯৬২ সালে গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে এনডিএফ গঠন ও আওয়ামী লীগের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে। ২২ অক্টোবর মোহাম্মদ নুরুল ইসলামের সভাপতিত্বে ও এডভোকেট বদিউল আলমের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত জনসভায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার আদায়ে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংগ্রামের ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। শেখ মুজিবুর রহমানও পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর শাসনের প্রক্রিয়া ও দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে তা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য জনগণকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন পরবর্তী সময়ে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা জটিল হতে থাকে। ওই দিকে ১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর ভারত উপমহাদেশের গণতন্ত্রের বরপুত্র হোসেন সোহরাওয়ার্দী বৈরুতের এক হোটেলে নিঃসঙ্গ অবস্থায় মারা যাওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে এক শূন্যতার সৃষ্টি হয়। পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগকে সাজাতে বঙ্গবন্ধু আবদুর রশিদ তর্কবাগীশকে নিয়ে মাঠে ময়দানে নেমে পড়েন। দল পুনর্গঠনে সর্ব শক্তি প্রয়োগ করেন এবং তিনি জেলা ও মহকুমা সফর করেন। এবং সফরের অংশ হিসেবে ১৯৬৪ সালের ৭ জুন রোববার শেখ মুজিব তার দলের সভাপতি মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী, প্রচার সম্পাদক হাফেজ হাবিবুর রহমান ও শ্রম সম্পাদক জহুর আহমদ চৌধুরী, এম এ আজিজ, আবদুল্লাহ আল হারুন চৌধুরীসহ চট্টগ্রাম জেলা নেতাদের নিয়ে কক্সবাজারে রাজনৈতিক সফরে আসেন। পথে আফসার কামাল চৌধুরীসহ অন্য নেতারা কক্সবাজার থেকে ১০ মাইল দূরবর্তী রামু পর্যন্ত গিয়ে এক বিশাল মোটর শোভযাত্রাপূর্বক জাতীয় নেতৃবৃন্দকে সংম্বর্ধনা প্রদান করে এবং তাদের কক্সবাজারে নিয়ে আসা হয়। রামু থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত গোটা পথে ‘আওয়ামী লীগ জিন্দাবাদ, ‘শেখ মুজিব জিন্দাবাদ’, ‘গণতন্ত্র জিন্দাবাদ’, ‘হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী জিন্দাবাদ’ প্রভৃতি ধ্বনি তুলে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তোলে।

কক্সবাজার আওয়ামী লীগের অভ্যর্থনা কমিটির আহ্বায়ক ফজলুল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কক্সবাজারের ঐতিহাসিক জনসমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের অর্থ কোথায় গেল জানতে চান এবং ১৯৪৭-১৯৬৪ সাল পর্যন্ত ১৭ বছরের হিসাব-নিকাশের জন্য আন্তর্জাতিক কমিশন দাবি করেছেন। দৈনিক ইত্তেফাকের ভাষ্যমতে, ‘গতকল্য অপরাহ্নে প‚র্ব্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান কক্সবাজারের ইতিহাসের বৃহত্তম জনসভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে গত ১৭ বৎসর প‚র্ব্ব পাকিস্তানের যে পরিমাণ টাকা পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করা হইয়াছে, অবিলম্বে তাহা আন্তর্জাতিক মর্যাদা সম্পন্ন অর্থনীতিবিদদের দ্বারা সঠিকভাবে নিরূপণ করিয়া প‚র্ব্ব পাকিস্তানকে ফিরাইয়া দেওয়ার দাবি জানান।’

তিনি বলেন- ‘পূর্ব পাকিস্তানের যে টাকা লওয়া হইয়াছে তাহা যদি ফিরাইয়া দেওয়া হয় এবং দেশে যদি খাঁটি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয় তাহা হইলে আমরা প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের বিরোধিতা করিব না।’

শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যে, ‘সত্য ও ন্যায়ের খাতিরে পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণকে তাহাদের ন্যায্য পাওনা এবং নিজেদের সম্পদ হইতে বঞ্চিত করা উচিত নয়।’

কক্সবাজারের ঐতিহাসিক জনসভায় যে সকল কৃষকের অন্তত ২৫ বিঘা জমি নাই তাদের খাজনা আগামী ২৫ বৎসর পর্যন্ত মওকুফ করা উচিত বলে মন্তব্য করে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যে, ‘যে সকল কৃষকদের অন্তত ২৫ বিঘা জমি না,ই আগামী ২৫ বৎসরের জন্য তাহাদের উপর নির্ধারিত খাজনা মওকুফ করা উচিত। দেশে যখন শিল্পপতিদের প্রাথমিক অবস্থায় করমুক্তির বিধান রহিয়াছে এবং মাসিক ৬ শত টাকার কম উপার্জনশীল ব্যক্তিদের আয়কর প্রদান করিতে হয় না, তখন দরিদ্র কৃষকদের খাজনা মওকুফ না করার কোনো কারণ থাকিতে পারে না। শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যে, ওয়ার্কস প্রোগ্রামের টাকা অনুৎপাদনশীল কার্যে ব্যয় করা হইতেছে।

বাঙালি জাতির আন্দোলন ও ত্যাগের ইতিহাস প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি জেনারেল শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘বাঙালিরাই পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা। পাকিস্তানের জন্যই তাহারা শতকরা ৯৬ ভাগ ভোট প্রদান করিয়াছিল। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় যে, বর্ত্তমানে তাহারাই ভোটাধিকার হইতে বঞ্চিত হইয়াছে।’
সভায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ, সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান, কোষাধ্যক্ষ নুরুল ইসলাম চৌধুরী, প্রচার সম্পাদক হাফেজ হাবিবুর রহমান, শ্রম সম্পাদক জহুর আহমদ চৌধুরী, চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মোজাফ্ফর আহমদ, সাধারণ সম্পাদক এম এ আজিজ, আফসার কামাল চৌধুরী, চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের কর্ম পরিষদের সদস্য আব্দুল্লাহ আল হারুন বক্তৃতা করেন।

সভায় প্রাপ্তবয়ষ্কদের ভোটাধিকার, সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ ও দমন নীতির তীব্র নিন্দা এবং প্রেস এ্যান্ড পাবলিকেশন অর্ডিন্যান্স বাতিল করিয়া সংবাদপত্রের পূর্ণ স্বাধীনতা এবং সকল রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে বিভিন্ন প্রস্তাব গৃহীত হয়।

৭ জুন রবিবার রাতে কক্সবাজার সী বীচ রেস্ট হাউস সংলগ্ন দক্ষিণ পাশের প্রথম কটেজ ‘তপতী’তে আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন উপলক্ষ্যে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত করতে এবং দেশের কোনো রাজনৈতিক জটিলতা নিরসনে আওয়ামী লীগ কর্মীকে পুনর্গঠনে আফসার কামাল চৌধুরীকে সভাপতি ও এডভোকেট নুর আহমদকে সাধারণ সম্পাদক এবং এ.কে.এম. মোজাম্মেল হককে কোষাধ্যক্ষ করে কক্সবাজার মহকুমা আওয়ামী লীগের কর্ম পরিষদ গঠন করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত কমিটির অন্যরা হলেন সহ-সভাপতি এডভোকেট ফজলুল হক, ফয়েজ আহমদ চৌধুরী, শেখ মকবুল আহমদ সিকদার, সাংগঠনিক মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম, ডা. শামসুদ্দিন আহমদ চৌধুরী, কোষাধ্যক্ষ একেএম মোজাম্মেল হক, শ্রম সম্পাদক জালাল আহমদ, সদস্য এডভোকেট জহিরুল ইসলাম, মওদুদ আহমদ, সালেহ আহমদ চৌধুরী, আলী আহমদ সিকদার, আবদুল্লাহ খান, আনোয়ারুল ইসলাম চৌধুরী বাবু মিয়া, কামাল হোসেন চৌধুরী।

১৯৬৫ সালের ১৪ এবং ১৫ ডিসেম্বর কক্সবাজার, সোনাদিয়া, কুতুবদিয়া, উখিয়া-টেকনাফ, মহেশখালীসহ চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূলীয় এলাকায় ঘণ্টায় ১২৪ মাইলের গতিবেগ সম্পন্ন ঘূর্ণিঝড় ও ৮ থেকে ১২ ফুট গতিবেগের জলোচ্ছ্বাস তাণ্ডবে ১১৫২০ প্রাণসহ দীপাঞ্চলের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি এবং অর্থনীতির বিপর্যস্ত হয়েছে। প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনের জন্য পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান তার দলের কোষাধ্যক্ষ নুরুল ইসলাম চৌধুরী, শ্রম সম্পাদক জহুর আহমদ চৌধুরীকে নিয়ে ১৬ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামে পৌঁছেন। দুর্গত এলাকার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণের প্রাথমিক হিসাব নিকাশের জন্য শেখ মুজিবুর রহমান ও তার দলের রাজনৈতিক সফর। ১৭ ডিসেম্বর শেখ মুজিবুর রহমান তার দলের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী, শ্রম সম্পাদক জহুর আহমদ চৌধুরী, চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধার সম্পাদক এম এ আজিজকে নিয়ে কক্সবাজারে গমন করেন। ওই দিন শেখ মুজিবুর রহমান কক্সবাজার টাউন কমিটির এলাকা, উখিয়া, টেকনাফ, চকরিয়া পরিদর্শন করেন এবং ওই সময় কক্সবাজার প্রশাসনের যথাযথ ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করেন। এসময় দুর্গত এলাকার ক্ষতিগ্রস্তদের খবরাখবর নেন এবং দুস্থদের মাঝে বস্ত্র বিতরণ করেন। কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকা পরিভ্রমণ শেষে সড়ক পথে চট্টগ্রামে চলে যান তাঁরা। ১৮ ডিসেম্বর মহেশখালী ও সোনাদিয়ায় গমন করে আওয়ামী লীগের রিলিফ সামগ্রি বিতরণ করেন শেখ মুুজিবুর রহমান।

সারাদেশের ন্যায় কক্সবাজারেও ৬ দফার প্রচার অভিযান চালানো হয়েছে। ছয় দফার বাণী মানুষের কাছে পৌঁঁছে দিতে শেখ মুজিবুর রহমান কক্সবাজারে আসেন ১৯৬৬ সালের ২৭ মার্চ। পাবলিক লাইব্রেরির ময়দানে কক্সবাজার শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি এডভোকেট ফজলুল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জনসভায় ছয় দফার গুরুত্ব তুলে বক্তব্য রাখেন। বক্তৃতার এক পর্যায়ে তিনি কক্সবাজার কলাতলীতে ধানী জমি নষ্ট করে যে সড়ক তৈরি করা হচ্ছে তার সমালোচনা করে বলেন, ‘কক্সবাজার কলাতলীতে যে রাস্তা নির্মাণ করা হচ্ছে তা কৃষকের অনুকূলে নয়’। সভায় বক্তব্য রাখেন এম এ আজিজ, জহুর আহমেদ চৌধুরী, আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ নুরুল ইসলাম চৌধুরী, এম এ হান্নান, এম এ মান্নান, আফসার কামাল চৌধুরী, এ কে এম মোজাম্মেল হক, কামাল হোসেন চৌধুরী।

১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে কক্সবাজার আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আয়োজিত এক নাগরিক সংবর্ধনায় যোগ দেন। কক্সবাজার সিভিল রেস্ট হাউস সংলগ্ন তপতী মাঠে আয়োজিত নাগরিক সংবর্ধনায় জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। সভায় আওয়ামী লীগের শ্রম সম্পাদক জহুর আহমদ চৌধুরী, চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম আর সিদ্দিকী, সাধারণ সম্পাাদক এম এ আজিজ, এম এ হান্নান, কক্সবাজার মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি আফসার কামাল চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট নুর আহমদ, ডা. শামসুদ্দিন আহমদ চৌধুরী, মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম, মীর্জা আবু মনসুর, আতাউর রহমান খান কায়সার, প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।

১৯৭০ সালের ২৭ এপ্রিল কক্সবাজার আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থীর জনসভায় ভাষণ দেন। আফাসার কামাল চৌধুরীর সভাপতিত্বে কক্সবাজার পাবলিক লাইব্রেরির মাঠে অনুষ্ঠিত সভায় শেখ মুজিব সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকার লবণ প্রস্তুতের উপর কেন্দ্রীয় আবগারি কর বিলোপ এবং চট্টগ্রাম ইস্পাত কারখানার বার্ষিক চার কোটি লোকসানের কারণ অনুসন্ধানের জন্য হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে তদন্ত দাবি করেন। জনসভায় সমুদ্র বালিয়াড়িতে খনিজ সম্পদ ধ্বংসের যে পাঁয়তারা সরকার করছে তার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান খনির দেশ। দেশের স্বাস্থ্যনগরী নামে পরিচিত কক্সবাজারে যে খনিজ সম্পদ আবিষ্কৃত হইয়াছে তা পশ্চিম পাকিস্তানিরা তুলে নিয়ে যাওয়ার চক্রান্ত করছে। বাংলার জনগণ বেঁচে থাকতে তা কোনো দিনই হতে দেবে না। পাকিস্তানপন্থী এক রাজনৈতিক নেতাও তাদের সাথে তাল মিলাচ্ছেন- আমি তাকে উদ্দেশ্য করে বলতে চাই- জনগণের সম্পদ জনগণের কাছে থাকতে দিন।’

১৯৭০ সালের ২৭ এপ্রিল সত্তরের নির্বাচনী প্রচারণার কাজ চালাতেও আসেন তিনি। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৩ সালে নির্বাচনী প্রচারণার অংশ এবং কক্সবাজারকে একটি সমৃদ্ধশালী পর্যটন শহর গঠন উপলক্ষে বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম পরিদর্শনে আসেন। সর্বশেষ বাকশাল চালুর পর রাষ্ট্রপতি হিসেবে ১৯৭৫ সালের ১০-১২ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে এসেছিলেন। এই সফরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কক্সবাজারের জন্য অনেক উন্নয়ন পরিকল্পনা করেছেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অনেকটা বাস্তবায়নও করেছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এশিয়ান হাইওয়ে, দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেল লাইন নির্মাণ, কক্সবাজারের লবণের উৎপাদকদের উপর লবণের কর অবিলম্বে বিলুপ্তকরণ, কক্সবাজারে একটি কলেজ ও একটি প্রযুক্তি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, তামাক উৎপাদনকারীদের উপর আরোপিত কর হ্রাস, তাঁত ও লবণ বোর্ড গঠন, কক্সবাজার সমুদ্রতীরে সুইমিং পুল, বিপনী কেন্দ্র, বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন গঠন, হিমছড়ি জলপ্রপাতের উন্নয়ন এবং সৈকতে কুঁড়ে ঘর নির্মাণ, রামুর নারকেল বাগান, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থার উন্নয়ন, যুদ্ধে বিধ্বস্ত কক্সবাজার বিমানবন্দর সংস্কার কার্যক্রম, পরমাণু শক্তি কমিশন, পরিকল্পিত দ্বীপ উন্নয়ন, মাতামুহুরী সেচ প্রকল্প, কুতুবদিয়া-চট্টগ্রাম-চাঁদপুর নৌপথ এবং কক্সবাজার-মহেশখালি জলপথে যাত্রী ও মালবাহী জাহাজ চালুকরণ, কুতুবদিয়া বাতিঘর উন্নয়ন এবং ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলা ও জলোচ্ছ¡াস রোধ ও সৈকতের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে ঝাউবাগান ও নারকেল বাগান তৈরি-সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ কার্যাদির পরিকল্পনা করেছিলেন। তন্মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে কিছুটা বাস্তবায়নও হয়, আর কিছুটা পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে বাধাগ্রস্ত হয় এবং পরবর্তীকালে সরকার বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পিত পরিকল্পনাসমূহ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে এবং অনেক উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়েছে।

তথ্যসূত্র:
১. ১০ জুন ১৯৬৪, দৈনিক ইত্তেফাক, উদ্ধৃতি- ‘সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু :’ দ্বিতীয় খন্ড, ষাটের দশক- প্রথম পর্ব, আগষ্ট ২০১৫, ঢাকা : বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট, ৩৯৬।

২. ১৯৬৩ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান প্রেস এ্যান্ড পাবলিকেশন্স অধ্যাদেশ পরিবর্তন করে প্রেস এন্ড পাবলিকেশন্স (সংশোধনী) অধ্যাদেশ জারি করেন। এই অধ্যাদেশই ছিলো সংবাদপত্রের কণ্ঠ চেপে ধরার অগাধ ক্ষমতা।

♦ কালাম আজাদ: সাংবাদিক, গবেষক এবং ‘কক্সবাজারে বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক গ্রন্থের প্রণেতা।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: উন্নয়ন, কক্সবাজার, বঙ্গবন্ধু
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন