চকরিয়ায় বন্যায় কৃষি খাতে ৭৪ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি

fec-image

কক্সবাজারের চকরিয়ায় এক সপ্তাহের অধিক সময় ধরে টানা ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট ভয়াবহ বন্যায় তলিয়ে গেছে পুরো উপজেলার গ্রামীণ জনপদ। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়ে প্রায় ৪ লক্ষাধিক বানভাসি মানুষ। বন্যার পানিতে ১৮টি ইউনিয়ন ও এক পৌরসভা এলাকার ব্যাপক ফসলী জমি ও সবজি ক্ষেতের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অতীতের সব রের্কড ভেঙে গেছে এবারের স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায়। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছেন প্রান্তিক চাষিরা। প্রবল ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে মাতামুহুরী নদীর দুই তীরসহ উপজেলার অন্তত ১৫টি ইউনিয়নের রোপা আমন, আউশ, বীজতলা ও সবজি ক্ষেত তলিয়ে গেছে বানের পানিতে। এতে বিস্তীর্ণ এলাকায় ফসলি জমি ও রকমারি সবজি ক্ষেত তছনছ হয়ে যায়।

বন্যায় প্রান্তিক চাষিরা চরম ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় কৃষকের মাথায় হাত উঠেছে। উপজেলা কৃষি বিভাগের মাঠ পর্যায়ের তথ্যমতে এবারের ভয়াবহ বন্যায় কৃষি খাতে উপজেলার ১৮ ইউনিয়ন ও পৌরসভা এলাকায় প্রায় ৭৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছেন। বন্যায় জমিতে ফলানো সবজি বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার মুহূর্তেই এ বারের বন্যায় কৃষকের সবস্বপ্ন ধুলিসাৎ করে দিয়েছেন। সবকিছু হারিয়ে পথে বসেছেন কৃষকরা। রবিবার বন্যাকবলিত এলাকা ঘুরে সরেজমিনে এই চিত্র পরিলক্ষিত হয়েছে।

জানা গেছে, টানা ভারি বর্ষণে বন্যা আর পাহাড়ি ঢলে উপজেলার সবজি ভান্ডার মাতামুহুরী নদীর দুই তীর এবং উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের অন্তত ৮১২ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন রকমারি সবজির আবাদ করেন প্রান্তিক চাষিরা। চলতি সবজি উৎপাদন মৌসুমে ৮১২ হেক্টর জমির কাঁকরোল, তিতকরলা, ঝিঙে, চিচিঙ্গা, বরবটি, শসাসহ রকমারি সবজির আবাদ হয়। চকরিয়া উপজেলার বন্যা কবলিত ১৮টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার প্রায় ৯০ শতাংশ এলাকায় সবজি ক্ষেত বানের পানিতে তলিয়ে যায়। আবাদ করা সবজির ৮১২ হেক্টর জমির মধ্যে ৬০২ হেক্টর রকমারি সবজির আবাদ সম্পূর্ণভাবে ক্ষতি হয়েছে। তাছাড়া আংশিকভাবে ক্ষতি হয় ২৬৩ হেক্টর সবজির আবাদ। এসব সবজি ক্ষেত থেকে সবজি তুলে বাজারে নিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। কিন্তু আকস্মিক ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল সৃষ্ট বানের পানিতে হাজারো কৃষকের স্বপ্নসহ সবকিছুই সর্বনাশ করে দিয়েছে।

এছাড়াও চলতি মৌসুমের রোপা আমন ও আউশের আবাদ হয় ৮ হাজার ১৬০ হেক্টর। এতে সম্পূর্ণ ভাবে ক্ষতি হয়েছে ২২৪৫ হেক্টর। তন্মধ্যে রোপা আমন আবাদে আংশিকভাবে ক্ষতি হয়েছে ৫ হাজার ৫৮৫ হেক্টর এবং আউশ আবাদে ক্ষতি হয়েছে ৭১২ হেক্টর ও আংশিকভাবে ক্ষতি হয়েছে ৪৬০ হেক্টর। এসময় বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে চলতি মৌসুমের ধানের বীজতলা। এতে পানিতে নিমজ্জিত ছিল ৫৮৫ হেক্টর। তন্মধ্যে বানের পানিতে সম্পূর্ণ ভাবে বীজতলা ক্ষতি হয়েছে ৫১২ হেক্টর, আংশিকভাবে ক্ষতি হয় ৮৩ হেক্টর।

উপজেলা কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, চকরিয়া উপজেলার ১৮ ইউনিয়ন এবং একটি পৌরসভায় কয়েক হাজার কৃষক রকমারি সবজির আবাদ করেন। কৃষকেরা কিছু কিছু সবজি ক্ষেত থেকে রকমারি সবজি তুলে বাজারেও নিয়ে যাচ্ছেন। এই অবস্থায় টানা ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় বেশি ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছে প্রান্তিক কৃষকেরা। চলতি মৌসুমে যে ভাবে ফসসি জমির রোপা আমন, আউশ, ধানের বীজতলা ও রকমারি সবজি ক্ষেত বন্যার পানিতে তলিয়ে নিয়ে গেছে তাতে মনে হয় না এই মৌসুমে নতুন করে আবাদ করে ঘুরে দাঁড়ানোর। এবারের বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উপজেলার সুরাজপুর-মানিকপুর, কাকারা, বমুবিলছড়ি, কৈয়ারবিল, বরইতলী, হারবাং, বিএমচর, পূর্ব বড় ভেওলা, কোনাখালী, ঢেমুশিয়া, পশ্চিম বড় ভেওলা, সাহারবিল, চিরিংগা, ফাঁসিয়াখালী ও পৌরসভায়। এসব ইউনিয়ন ও পৌরসভা এলাকায় মাতামুহুরি নদীর তীরবর্তী যেসব সবজির আবাদ হয়েছিল তা ভয়াবহ বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। এতে কৃষকেরা চরম ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

চকরিয়া পৌরসভার এলাকার কৃষক নাজিম উদ্দীন জানান, তিনি ৬০ শতক জমিতে কাকরোল, বরবটি, শসাসহ বিভিন্ন রকমারি সবজির চাষ করেন। এতে তাঁর খরচ হয়েছে প্রায় এক লাখ ১০ হাজার টাকা। কিন্তু তার ক্ষেতের সবকিছু বন্যার পানিতে চলে গেছে। আগে বৃষ্টি হলেও অল্প সময়ে পানি নেমে যেত। কিন্তু এবার টানা বর্ষণ ও মাতামুহুরী নদীতে নেমে আসা উজানের ঢলের পানিতে সবকিছুই তলিয়ে গেছে।

চকরিয়া পৌরসভার দুই নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর রেজাউল বলেন, ‘আমার ওয়ার্ডের সিংহভাগ মানুষ মাতামুহুরীর চরে সবজি চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। ভয়াবহ এই বন্যায় কম করে হলেও তিন শতাধিক সবজি চাষি ক্ষতির শিকার হয়ে পথে বসেছেন।
একই গ্রামের আরো বেশ কয়েকজন কৃষকের সাথে কথা হলে তারা একই তথ্য এ প্রতিবেদককে জানালেন।
কৃষকেরা জানায়, মাতামুহুরী নদীর তীরের প্রায় ৩০০ হেক্টর জমিতে রকমারি চাষ করেছেন। তৎমধ্যে কাকরোল, তিত করলা, ঝিঙে, চিচিঙ্গা, বরবটি, শসাসহ বিভিন্ন রকমারি সবজি। ইতোমধ্যে এসব ক্ষেতে ফলনও এসেছে। বানের পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় তাদের কযেক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে প্রান্তিক চাষিরা দাবী করেছেন।

সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম দাবি করেছেন, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট ভয়াবহ বন্যায় পুরো এলাকাজুড়ে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নদীর তীরবর্তী এলাকায় সকল সবজি ক্ষেত পানির প্রবল স্রোতে তলিয়ে যায়। এতে বড় ধরনের ক্ষতি হয় কৃষকের।

কাকারা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, কাকারা ইউনিয়ন মাতামুহুরী নদী বেষ্টিত। তাই শুষ্ক ও বর্ষা মৌসুমে অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি ব্যাপকভাবে সবজিচাষ হয়। বন্যার তাণ্ডবে সবজি চাষিদের এখন মাথায় হাত উঠেছে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এস.এম নাসিম হেসেন বলেন, ভয়াবহ বন্যায় চকরিয়া উপজেলায় ফসলি জমি ও সবজি ক্ষেতের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। মাঠ পর্যাযের তথ্যমতে এবারের ভয়াবহ বন্যায় কৃষি খাতে উপজেলার ১৮ ইউনিয়ন ও পৌরসভা এলাকায় প্রায় ৭৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, চলতি মৌসুমে জমিতে আবাদ করা রোপা আমন, আউশ, বীজতলা ও রকমারি ফলানো সবজি বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে কৃষকেরা আর্থিকভাবে লাভবানের চেয়ে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মাতামুহুরী নদীর দুই তীরসহ উপজেলার অন্তত ১৫টি ইউনিয়নের ফসলি জমি ও সবজি ক্ষেত বানের পানিতে নিমজ্জিত ছিল। এতে বিস্তীর্ণ এলাকায় ফসলি জমি ও রকমারি সবজি ক্ষেত সর্বনাশ হয়ে যায়। যেসব চাষিরা ক্ষতির শিকার হয়েছেন তাঁদেরকে প্রণোদনা এবং নতুন করে বীজ সরবরাহ করার বিষয়টি মাথায় রয়েছে। যাতে প্রান্তিক কৃষকেরা আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারেন।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: কৃষি, ক্ষয়ক্ষতি, চকরিয়া
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন