পার্বত্য চট্টগ্রাম: ইতিহাস জানার প্রয়োজনীয়তা

জেনারেল ইব্রাহীম

সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে আমার লেখা চারটি কলাম ইতোমধ্যেই পাঠকের সামনে নিবেদিত হয়েছে; যথাক্রমে ১১, ১৮, ২৫ মার্চ ও ১ এপ্রিল। পাঠ করার পর স্বাভাবিকভাবেই পাঠকপ্রতিক্রিয়া আসবে; ভালো ও মন্দ। তবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্তকারীদের মধ্যে সার্বিকভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ তথা বিপুলসংখ্যক লোক, বিশেষ করে তরুণেরা বললেন, এমন অনেক কিছুই জানতে পারলাম যেটা এ পর্যন্ত জানতাম না। আপনি (জেনারেল ইবরাহিম) যেহেতু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লিখেছেন, সেহেতু আমাদের নিকট সেটা বিশ্বাসযোগ্যতা পাচ্ছে। লেখক হিসেবে আমার মন্তব্য হলো, আলোচনা ও সমালোচনা থাকবেই; এটা মেনে নিয়েই কলাম লিখতে হবে; যদি লিখতে চান।

পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক প্রথম কলাম প্রকাশিত হয়েছে ১১ মার্চ। শুরুই করেছিলাম কমিউনিকেশন গ্যাপ এবং জেনারেল গ্যাপ- এ দু’টি শব্দের ব্যাখ্যা দিয়ে। ১৯৮৭-১৯৮৮- ১৯৮৯ সালে যারা শিশু, তারা এখন বাংলাদেশে ২৮-২৯-৩০ বয়সের যুবক। ১৯৯৭ সালে যখন পার্বত্য শান্তিচুক্তি হয়, তখন যার জন্ম হয়েছিল, তিনি এখন ভোটার হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। যেকোনো ব্যক্তির জন্মের আগের এক বা দুই যুগ অথবা অর্ধশতাব্দী বা এক শতাব্দী বা পাঁচ শতাব্দী পুরনো ইতিহাসের সব কিছু মুখস্থ করা বা জেনে রাখা সম্ভব নয়। কিন্তু নিকট ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাত্তগুলো নিজের স্বার্থেই জেনে রাখা প্রত্যেকের জন্য প্রয়োজন। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় ভাইবোনদের মধ্যে যারা তরুণ, তাদের জানা

প্রয়োজন তাদের আন্দোলনের ইতিহাস এবং ভুলভ্রান্তিগুলো। অবশ্যই সফলতাগুলো থেকে প্রেরণা নেবেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালি ভাইবোনদের মধ্যে যারা তরুণ, তাদেরও জানতে হবে কোন কোন ধাপ বা পর্যায় পার হয়ে পরিস্থিতি আজ এই পর্যায়ে এসেছে। সামরিকবাহিনীর সদস্য যারা এখনো পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকরি করছেন, তাদেরও জানা প্রয়োজন- কেনই বা সেনাবাহিনী মোতায়েন হয়েছে।

তত্ত্বীয় জ্ঞান ও বাস্তবতার সম্পর্ক এবং উদ্দেশ্য
১৯৮২ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৮৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ১৩ মাস ইংল্যান্ডে অবস্থিত, বিশ্ববিখ্যাত ‘দি রয়্যাল স্টাফ কলেজ ক্যাম্বারলি’-তে লেখাপড়া করেছি। সেখানে যাওয়ার আগেই যেহেতু পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকরি করেছি, সেহেতু আমি ব্যক্তিগতভাবে ইন্সারজেন্সি এবং কাউন্টার ইন্সারজেন্সি সম্বন্ধে ধারণা পেয়েছিলাম। ইংল্যান্ডে পড়ার সময় তৃতীয় সেমিস্টারে সিলেবাসে এটাই ছিল মুখ্য পাঠ্য বিষয়। উত্তর আয়ারল্যান্ডের সমস্যা, ওমানের ধোফারের সমস্যা, ইত্যাদি ছিল পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল। সহপাঠীদের মধ্যে আরো ২৫- ৩০ জন ছিলেন, যারা নিজ নিজ দেশে এইরূপ ইন্সারজেন্সি ও কাউন্টার ইন্সারজেন্সি নামে বিষয়ের সাথে পরিচিত ছিলেন। পারস্পরিক ইন্টার-অ্যাকশনের মাধ্যমে আমরা নিজেদের অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি করতাম। বাংলাদেশে ফিরে এসে ১৯৮৪, ১৯৮৫ ও ১৯৮৬- এ তিনটি অ্যাকাডেমিক বর্ষে মিরপুর ক্যান্টনমেন্টে অবস্থিত, বিখ্যাত ‘স্টাফ কলেজ’-এ শিক্ষকতা করার সময় তৃতীয় সেমিস্টারে ইন্সারজেন্সি এবং কাউন্টার ইন্সারজেন্সি বিষয়ে প্রত্যক্ষভাবে অংশীদার ছিলাম। ইন্সারজেন্সি ও কাউন্টার ইন্সারজেন্সি প্রসঙ্গে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা এখনো পুরোপুরি ইতিহাস নয়; সাম্প্রতিক আর চলমান ইতিহাস। তাই তরুণদের আহ্বান জানাচ্ছি সচেতন হওয়ার জন্য। উদাহরণস্বরূপ, প্রত্যেক সেনাসদস্য আকাঙ্ক্ষা রাখেন, পদোন্নতি পেয়ে পেয়ে ওপরে উঠবেন এবং গুরুত্বপূর্ণ থেকে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করবেন। যারা নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে সিরিয়াস, তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়েও সিরিয়াস হবেন, এটাই আমার একান্ত পরামর্শ। কারণ, আজ যিনি লেফটেন্যান্ট বা ক্যাপ্টেন অথবা নবীন মেজর, দশ বছর পর আপনি কর্নেল, ব্রিগেডিয়ার হিসেবে কোন জায়গার কোন দায়িত্বে নিয়োজিত হবেন, সেটা আপনি জানেন না। কিন্তু ক্যারিয়ারের স্বার্থেই আপনার প্রস্তুতি প্রয়োজন। প্রস্তুতির নিমিত্তে ছোট্ট একটি কথা দিয়ে পাঠককে উৎসাহিত করতে চাই।

১৯৮৯-৯০ সালে আমেরিকার পেনসিলভানিয়া রাজ্য বা প্রদেশের কারলাইল ব্যারাকসে (বাংলাদেশের পরিভাষায় কারলাইল ক্যান্টনমেন্ট) অবস্থিত ‘ইউনাইটেড স্টেটস আর্মি ওয়ার কলেজ’-এ ১২ মাস ছাত্র ছিলাম। ওই কলেজের নীতিবাক্য বা মটো ছিল- ‘নট টু প্রমোট ওয়ার বাট টু প্রিজার্ভ পিস।’ অর্থাৎ, ওয়ার কলেজে লেখাপড়ার উদ্দেশ্য যুদ্ধকে উৎসাহিত করার জন্য নয়, বরং শান্তি রার জন্য। পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে জানার উদ্দেশ্যও সেখানে সঙ্ঘাত বৃদ্ধি করা নয় বরং কম বা বেশি যতটুকুই শান্তি বিরাজ করছে, সেই শান্তিকে আরো বৃদ্ধি ও বাস্তবসম্মত করা।

পার্বত্য চট্টগ্রামে চলমান রাজনীতি
বিগত দু’টি কলামে সুনির্দিষ্টভাবে বাঙালি ও ভূমি প্রসঙ্গ নিয়ে লিখেছি। এবারের প্রসঙ্গ আদিবাসী। এ প্রসঙ্গে সম্ভবত তিনটি কলাম হবে। বর্তমান কলামটি ওই সুবাদে প্রথম। বাঙালিরা গত ৩৭ কিংবা ২৭ বছর ধরে যত কষ্টই করুক না কেন, তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম ছেড়ে যায়নি। রোগে-শোকে যারা মারা গেছে, তাদের কথা বাদ দিলাম। ১৯৮২ সালের জুন মাসের পরে সরকারি উদ্যোগে কোনো বাঙালি পার্বত্য চট্টগ্রামে সেটেলড হয়নি। এর আগে যত বাঙালি ছিল তারাই আছে, তাদের কষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু ইতোমধ্যে পাহাড়ি জনগণ ও বাঙালি জনগণ, উভয়ের মধ্যেই রাজনৈতিক সচেতনতা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অল্প কিছু পাহাড়ি আছেন, যারা বিএনপি করেন। অল্প কিছু বাঙালি আছেন, যারা পাহাড়িদের সমর্থন করেন। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে ভোট পাওয়ার প্রতিযোগিতা আছে, কিন্তু আমার একাডেমিক মূল্যায়নে পার্বত্য সমস্যাটি বোঝার জন্য উভয়ের মধ্যে কোনো প্রতিযোগিতা নেই। কলামের এই স্থানে দু’টি আক্ষেপের বাক্য লিপিবদ্ধ করলাম, যথা : ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের এখন মা-বাবা নেই; পার্বত্য চট্টগ্রাম এতিম।’ এই আক্ষেপের ব্যাখ্যা আজ নয়, পরে কোনো এক সময় দেবো ইনশাআল্লাহ। জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমা, রাঙ্গামাটিতে অবস্থিত আঞ্চলিক পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান। ১৯৯৮ সাল থেকে অনির্বাচিত অবস্থায় ১৭ বছর এ পদে আছেন। জনসংহতি সমিতিতে বিভাজন এসেছে।

ইউপিডিএফ নামে সংগঠন সৃষ্টি হয়েছিল ১৯৯৭-এর চুক্তির দু-এক বছর আগে। তারা এখন বেশ শক্তিশালী অবস্থানে। এ সব কিছুর সাথে আট-দশ বছর ধরে যুক্ত হয়েছে ‘আদিবাসী’ আন্দোলন। এই আন্দোলনের ভেতরে এমন কিছু মারপ্যাঁচ অথবা গিট্টু লুকায়িত আছে, যেগুলো আবিষ্কার করে মোকাবেলা করা না হলে আমার মতে, জনসংহতি সমিতি ২২ বছরের সশস্ত্র আন্দোলনে যা করতে পারেনি, এই নীরব কাগজ-কলমের আন্দোলনের মাধ্যমে তার থেকেও বেশি সাফল্য অর্জন করে ফেলবে। তখন বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও অস্তিত্ব প্রচণ্ড হুমকির সম্মুখীন হবে। ওই প্রসঙ্গেই তিনটি কলামের এটি প্রথম কিস্তি।

বিভিন্ন জনপদে মানুষের উৎপত্তি প্রক্রিয়া
জাতিসঙ্ঘের জন্ম ১৯৪৫ সালে। শুরুতে সদস্য ছিল ৫১টি রাষ্ট্র। কিন্তু ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ যখন জাতিসঙ্ঘের সদস্য হয়, তখন সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় ১৩৮-এ। ২০১১ সালে সর্বশেষ সদস্য সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৯৩। অর্থাৎ এ মুহূর্তে ১৯৩টি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র আছে, যাদের মান-মর্যাদা অন্তত কাগজে-কলমে সমান। এ ১৯৩টি দেশের মধ্যে অনেক দেশ আছে, যেখানে জনসংখ্যা নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিবিধ প্রকারের। ওই দেশের মাটিতে সবচেয়ে আগে কোন মানুষটি বসবাস শুরু করেছিল, (কথার কথা) দুই শ’ বা পাঁচ শ’ বা নয় শ’ বা সতেরো শ’ বা তেত্রিশ শ’ বছর আগে; সেটা সুনির্দিষ্টভাবে বলা খুব কঠিন। জ্ঞানের যে দু’টি শাখা এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করে, তার নাম নৃবিজ্ঞান বা এনথ্রোপোলজি এবং জাতিতত্ত্ব বা এথনোলজি।

একটা বনে যেমন অনেক গাছগাছড়া থাকে, তেমনি একটি জনপদে অনেক ধরনের মানুষ থাকে। গভীর অরণ্যের গাছগুলো মানুষ গিয়ে লাগায়নি। প্রাকৃতিক নিয়মে, পশুপাখির মাধ্যমে গাছের বিচি বা ফুল এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছড়াতে ছড়াতে বনের মধ্যে ওই গাছের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। পরিকল্পিতভাবে বন সৃষ্টির ধারণা বেশি পুরনো নয়। যে নিয়মে প্রাকৃতিক বনের মধ্যে গাছগাছড়া ছড়ায়, সে নিয়মেই কি কোনো একটি ভূমিতে মানুষ ছড়িয়ে পড়ে? উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশের দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরের বুকে নতুন দ্বীপ সৃষ্টি হয়ে সবার নজরে পড়েছিল ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগে। নাম নিঝুম দ্বীপ। এর মাটিতে বিভিন্ন প্রকারের গাছ জন্ম নিয়েছে প্রাকৃতিকভাবে। আবার নিঝুম দ্বীপে সমুদ্রের উপকূলে বন সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশের বন বিভাগ। নিঝুম দ্বীপে যেন হরিণ জন্ম নেয়, তার জন্য কয়েক জোড়া হরিণ প্রথম দিকে ওই বনে ছেড়ে দিয়ে আসা হয়; সেগুলো থেকে বংশ বৃদ্ধি পেয়ে এখন হাজার হাজার হয়েছে। কিন্তু নিঝুম দ্বীপের মাটি ভেদ করে হঠাৎ কোনো পুরুষ বা মহিলা জাগ্রত হয়ে বলেনি যে, ‘আমি এই দ্বীপের প্রথম মানুষ।’ নিঝুম দ্বীপে এখন মানুষ আছে এবং তারা বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে গিয়েছেন। সমুদ্র বা মহাসাগরের মাঝখানে অনেক দ্বীপ আছে এবং সেখানে মানুষের বসতিও আছে। তাদের মধ্যে একদম প্রথম মানুষের জোড়া কোনটি, যাদের থেকে বংশ বৃদ্ধি হলো, সেটা আবিষ্কার করা অসম্ভব না হলেও কষ্টকর। এটুকু অবশ্যই নিশ্চিত করে বলা যায়, ওই মানুষটি বা ওই মানুষ-জোড়া ঘাসের চারার মতো মাটি ভেদ করে ওঠেনি। ইসলাম ধর্মের শিক্ষা মোতাবেক শুধু প্রথম মানুষের জোড়া তথা প্রথম নবী হজরত আদম আ: এবং তাঁর সম্মানিত স্ত্রী হাওয়া আ:কে স্বর্গ থেকে আল্লাহ কর্তৃক পৃথিবীতে অবতীর্ণ করে দেয়া হয়েছিল। মানুষ জাতির সবাই আদম-হাওয়া আ:-এর বংশধর।

পার্বত্য চট্টগ্রামে মানব বসতির ইতিহাস
যেহেতু আমাদের পক্ষে মনুষ্যবিহীন ক্ষুদ্র বিমানে (যার নাম ড্রোন) চড়ে ইতিহাসের পাঁচ শ’ বছর পেছনে গিয়ে, যথা ১৫১৫ সালের মার্চ মাসে পার্বত্য চট্টগ্রামের মাটিতে মানুষ খোঁজা সম্ভব নয়। তাহলে আমাদের সামনে একটাই রাস্তা খোলা আছে মানুষ খোঁজার; তা হলো ২০১৫ সাল থেকে পেছনের দিকে যেতে থাকা। ২০০০ সাল, ১৯৮৭ সাল, ১৯৭১ সাল, ১৯৪৭ সাল, ১৯৩৫ সাল, ১৯০০ সাল, ১৮৬০ সাল, ১৭৯০ সাল, ১৭৫৭ সাল, ১৭০০ সাল, ১৬৫৪ সাল, ১৬০০ সাল, ১৫২৬ সাল, ১৪৭২ সাল ইত্যাদি নিয়মে বছর ধরে ধরে গবেষণা করে বের করতে হবে ওই সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের কোন কোন জায়গায় কোন কোন মানুষ ছিল। গবেষণা করার সময় পাইনি, পাবোও না। কিন্তু অন্যদের গবেষণার  সারমর্ম হলো, পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমানে যারা বসবাস করেন, তাদের কেউই ওখানকার মাটি থেকে চারাগাছের মতো মাটি ভেদ করে ওপরে ওঠেননি; ওই মানুষেরা উত্তর-দক্ষিণ, পূ পূর্ব-পশ্চিম কোনো না কোনো এলাকা থেকে এসে সেখানে বসতি স্থাপন করেছেন। কেউ আগে, কেউ পরে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি সার্কেলের পরিচয় ১১ মার্চের কলামে দিয়েছি। বান্দরবান-কেন্দ্রিক সার্কেলের নাম হলো বোমাং সার্কেল। এ সার্কেলের প্রধান (ইংরেজিতে চিফ) তথা বোমাং রাজা হচ্ছেন বোমাং রাজবংশের প্রতিভূ। বর্তমান রাজার নাম উ চ্য প্রু। তার আগে ছিলেন কে এস প্রু। তার আগে ছিলেন অং শ্যু প্রু। অং শ্যু প্রু মারা যাওয়ার বছরখানেক আগে চ্যানেল আইয়ের সাথে একটি ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন। সে ইন্টারভিউতে তিনি সুন্দর সাবলীল ভাষায় বোমাং রাজবংশ এবং মার্মারা পার্বত্য চট্টগ্রামের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত কোন জায়গা থেকে কখন বর্তমান বান্দরবান জেলায় এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন, তার বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “আমরা এখানে এসেছি তিন শ’-সোয়া তিন শ’ বছর আগে।” বর্তমানের পার্বত্য চট্টগ্রামের মধ্য ও উত্তরাংশে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে যে উপজাতি তার নাম চাকমা। তারাও বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তর ও উত্তর-পূর্ব এলাকা থেকে দুই বা তিন বা চার শ’ বছর আগে এসে বসতি স্থাপন করেছেন। ১৩০ বছর আগেও তাদের রাজাদের বসতি বা রাজধানী ছিল আমার গ্রামের বাড়ি থেকে চন্দ্রঘোনা হয়ে কাপ্তাই যাওয়ার পথে চন্দ্রঘোনার কয়েক মাইল পূর্বে রাজানগরে। পার্বত্য চট্টগ্রামে অন্যান্য যারা উপজাতি আছেন, তারাও পার্বত্য চট্টগ্রামে নিকট বা মধ্যবর্তী ইতিহাসের কোনো একটি সময়ে এসে বসতি স্থাপন করেছেন। বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করে, এমন উপজাতিগুলোর নাম উল্লেখ করছি। (১) চাকমা, (২) মারমা বা মগ, (৩) ত্রিপুরা বা ত্রিপুরী, (৪) লুসাই, (৫) খুমি, (৬) বোম, (৭) খেয়াং বা খিয়াং, (৮) চাক, (৯) কুকি, (১০) তংচৈঙ্গা, (১১) পাংখু, (১২) রাখাইন।

আদিবাসী শব্দের উৎপত্তি ও বিকাশ
বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রামে এ ১২টি উপজাতির জনসংখ্যা যত, সেখানে বসবাসরত বাঙালিদের জনসংখ্যাও প্রায় তত; একটু কম। এই বাঙালিরাও নিকটবর্তী বা মধ্যবর্তী কোনো অতীত সময়ে মাটি থেকে চারাগাছের মতো গজায়নি; তারাও উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিমে অবস্থিত অঞ্চলগুলো থেকে গিয়েছে। বিশেষত পূর্ব, উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব থেকে। তাহলে প্রশ্ন থেকেই যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামে সবচেয়ে পুরনো অধিবাসী কারা বা মূল অধিবাসী কারা? ইংরেজি শব্দ অরিজিনালের অনুবাদ করা হচ্ছে আদি। প্রাচীনতম অধিবাসীকে ইংরেজি ভাষায় তিরিশ-চল্লিশ বছর আগেও ‘অ্যাবোরিজিনাল’ বলা হতো। আনুমানিক ষাট বছর আগে জাতিসঙ্ঘের একটি অঙ্গসংগঠনের উপ-অঙ্গসংগঠন আরেকটি ইংরেজি শব্দ প্রয়োগ করা শুরু করে। ওই নতুন ইংরেজি শব্দটি হলো ‘ইনডিজেনাস’। ইংরেজি শব্দ ইনডিজেনাসের বাংলা প্রতিশব্দ করা হয়েছে ‘আদিবাসী’।

বাংলাদেশে ‘আদিবাসী’ শব্দের ব্যবহার
বাংলাদেশের লেখাপড়া জানা মহলের এবং রাজনৈতিক মহলের একটা অংশ জেনেশুনেই পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীকে ‘আদিবাসী’ বলে সম্বোধন করছেন। ঘটনাক্রমে এ অংশটি বাংলাদেশের রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গনে বামপন্থী ও ধর্মনিরপেপন্থী বা ধর্মহীন হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেছে এবং সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী জনগোষ্ঠী নেই। কিন্তু এমন অনেক ব্যক্তি যারা সরকারের সাথেও সংশ্লিষ্ট, তারাও অবলীলাক্রমে ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার করেই যাচ্ছেন। শব্দটা যদি শুধু শব্দই হতো বা একটি টাইটেল বা একটি অলঙ্কার হতো; তাহলে হয়তো মারাত্মক সমস্যা হতো না। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার যদি (সঠিকভাবে বা বেঠিকভাবে হোক) যেকোনো নিয়মে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠীকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে ঘোষণা করে বা আদিবাসী হিসেবে আইনানুগ পরিচয় স্থির করে, তাহলে এর তাৎপর্য কী হতে পারে- এ সম্বন্ধে বামপন্থী ও ধর্মনিরপেক্ষপন্থী বা ধর্মহীনতাপন্থী হিসেবে পরিচিত ব্যক্তিরা অবহিত আছেন কি না, এটা স্পষ্ট করে বলতে পারছি না। কিন্তু ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক, রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তি-অঙ্গনের ওই ব্যক্তিরা এই শব্দের অযাচিত ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশের নিরাপত্তার যে তি করছেন, সেটা তুলে ধরাই আমার এই কলামের বা পরবর্তী দু’টি কলামের অন্যতম উদ্দেশ্য। এটা বুঝতে হলে তিনটি ডকুমেন্ট বা দলিলের সাথে পরিচিত হতে হবে। আগামী কলামে সেটা নিয়ে আলোচনা করব।

লেখক : মেজর জেনারেল (অব:), চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন