এক ডজন সন্ত্রাসী বাহিনীর দখলে কক্সবাজার শহর

2515

স্টাফ রিপোর্টার:

কক্সবাজার শহরের অর্ধেক এলাকা সন্ত্রাসীদের দখলে চলে গেছে। এক ডজন বাহিনীর দু’শতাধিক দাগি সন্ত্রাসী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এসব এলাকা। কিন্তু সেখানে আইনশৃংখলা বাহিনীর নিরব ভূমিকায় মানুষ নির্যাতিত হচ্ছে। নিরবে সব সহ্য করছে তারা। আইনশৃংখলা বাহিনীর রহস্যজনক ভূমিকায় সন্ত্রাসীরা নিজেদের মধ্যে খুনাখুনিতে লিপ্ত রয়েছে। গত ৫/৬ বছরে ওই এলাকায় ১০ জন খুন হয়েছে। কিন্তু খুনিদের পুলিশ গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হওয়ায় ওই সব এলাকায় সন্ত্রাসীরাই রাজত্ব করছে।

প্রায় প্রতি রাতেই সেখানে ফাঁকা গুলি বর্ষনের ঘটনা ঘটে। সন্ত্রাসী বাহিনীগুলো নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে এলাকাগুলোতে স্বশস্ত্র মহড়া ও ফাঁকা গুলি ছুঁড়ছে। যার কারণে এলাকাগুলোতে বসবাসকারীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। সেখানে অধিকাংশ মানুষ নিয়মিত চাঁদা দিয়েই বসবাস করছে। এসব বাহিনীকে চাঁদা না দিয়ে জমি ক্রয়-বিক্রয়, ঘর নির্মাণ, সীমানা দেয়াল নির্মান, ব্যবসা-বাণিজ্য কোন কিছুই সম্ভব নয়। গত ৩ মাসে পুলিশ কোন অভিযানই সেখানে পরিচালনা করেনি বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর। যার কারণে পুরনো সন্ত্রাসীরা ফের ফিরে এসে আবারো এলাকার নিয়ন্ত্রন নিয়েছে।

সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজার শহরের ঘোনারপাড়া, বৈদ্যঘোনা, বাদশাঘোনা, ফাতেরঘোনা, খাজা মঞ্জিল, ইসলামপুর, পাহাড়তলী, বাঁচামিয়ারঘোনা, আবু উকিলের ঘোনা, ইসুলুঘোনা, সমিতিবাজার, দক্ষিণ রুমালিয়ারছড়া, সাহিত্যিকাপল্লী, লারপাড়া, আমতলী, জেলখানার পেছনের এলাকা, সবুজ সওদাগরের ঘোনা, গয়ামতলী, লাইটহাউজ পাড়া, রহমতপুর, জেলা কারাগার এলাকা সহ শহরের অর্ধেক এলাকার নিয়ন্ত্রন বর্তমানে এক ডজন সন্ত্রাসী বাহিনীর হাতে। প্রশাসনের তালিকাভূক্ত সন্ত্রাসী হাসনাত বাহিনী, রকি বাহিনী, নুরু বাহিনী, সিফাত বাহিনী, বশর বাহিনী, মুজিব বাহিনী, খুরশেদ বাহিনী, জাকির মোস্তফা বাহিনী, পুতু বাহিনী, সৌরভ বাহিনী, সালাহউদ্দিন বাহিনী, রফিক বাহিনী সহ এক ডজনেরও বেশি বাহিনী’র নিয়ন্ত্রনে দু’শতাধিক দাগি সন্ত্রাসী রয়েছে। তাদের অধিকাংশই রোহিঙ্গা। বাহিনী প্রধানরা রোহিঙ্গাদের দলে নিয়ে অপকর্ম করছে। এর মধ্যে বাহিনী প্রধান সালাহউদ্দিনকে সম্প্রতি গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

অপরদিকে রকি বাহিনীর প্রধান রকি আদালতে আত্মসর্মপন করে কারাগারে রয়েছে। কারাগার থেকেই তার নির্দেশে বাহিনীর কর্মকান্ড চলছে। এসব বাহিনীর সদস্যদের কাছে রয়েছে অত্যাধুনিক নাইন এমএম পিস্তল সহ শতাধিক মারণাস্ত্র। প্রকাশ্যে এসব অস্ত্র নিয়ে এলাকাগুলোতে মহড়া দেয় তারা। আধিপত্যের জেরে এসব বাহিনীর হাতে খুন হয়েছেন আলাউদ্দিন, জসিম উদ্দিন, আরজু, নুরু, শফিক সহ ১০ জন সন্ত্রাসী। সর্বশেষ গতকাল মুজিব ও বশর বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে খুন হন আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী জাকির মোস্তফা। জাকির মোস্তফা’র বিরুদ্ধে হত্যাসহ ১৪টি মামলা রয়েছে। সে পুলিশের সোর্স হিসেবেও কাজ করতো।

পুলিশ সূত্র জানায়, এসব সন্ত্রাসী বাহিনীর অধিকাংশই সেনাবাহিনীর রেষ্ট হাউস ডাকাতি, ঈদগড়ে পুলিশ খুন, চাঞ্চল্যকর কয়েকটি ডাকাতি ও হত্যা মামলার আসামী সহ ডজন ডজন মামলার দাগি আসামী। তারা দীর্ঘদিন ধরে পুলিশের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করছে। সূত্র আরো জানিয়েছে, ক্ষমতাসীন দলের কিছু স্থানীয় নেতা এসব বাহিনীকে আশ্রয় দেয়ার কারণে তারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আইনশৃংখলা বাহিনীও তাদের ধরতে সাহস পান না। অনেক সময় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলেও রাজনৈতিক তদবীরে পুলিশ ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এসব সন্ত্রাসী কিছু সুবিধাভোগী  রাজনৈতিক নেতার আশ্রয়ে থেকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পুরো শহর। সন্ত্রাসীরা কখনো পুলিশের হাতে আটক হলেও তাদের রাজনৈতিক কর্মী পরিচয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে যান নেতারা। এলাকাবাসী অভিযোগ করে জানান, দীর্ঘদিন ধরে এসব বাহিনী শহরের অর্ধেক এলাকা নিয়ন্ত্রন করছে। কিন্তু সেখানে পুলিশের কোন অভিযান নেই।

পুলিশের গোয়েন্দা ইউনিটের কোন একজন যদি ওইসব এলাকায় হেঁটে আসেন তবে বুঝতে পারবেন এলাকাগুলোর অবস্থা কি। কোন সাধারণ মানুষ এসব এলাকায় একা হেঁটে যেতে পারেন না। স্থানীয় দোকানদাররা অধিকাংশই চাঁদা দিয়ে ব্যবসা করছেন। আর অপহরণ করে মুক্তিপন আদায় চলছে নিয়মিত। এলাকার অনেকেই সন্ত্রাসীদের অত্যাচারে ঘর-বাড়ী ফেলে এলাকা ছেড়ে গেছে। শহরের পাহাড়তলীর এক দোকানদার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমরা অধিকাংশ ব্যবসায়ি এখানে সন্ত্রাসীদের চাঁদা দিয়ে ব্যবসা করছি। এছাড়া কোন উপায় নেই।’ ইসলামপুরের আবদুল হক নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘সন্ত্রাসীদের অত্যাচারে গত এক বছরে ৩০ জনেরও বেশি মানুষ এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। এসব এলাকায় কোন গোয়েন্দা এসে খোঁজ নিলেই সব তথ্য মিলবে।’ জেলা কারাগার এলাকার আবদুস সবুর বলেন, ‘পুলিশের কথা বলে লাভ নেই। অভিযোগ নিয়ে থানায় গিয়ে দেখেন তবে বুঝতে পারবেন ভূক্তভোগীদের কি হাল। এলাকাগুলোতে কি হচ্ছে পুলিশ কি তা দেখেনা?’ কক্সবাজার শহরের দক্ষিণ রুমালিয়ারছড়ার সমিতিবাজারের রহিমুল্লাহ বলেন, ‘এখানে অধিকাংশ মানুষ নিরবে চাঁদা দিয়েই জমি কিনে ঘর তৈরী করে বসবাস করছে।’

কক্সবাজার জেলা আওয়ামীলীগের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে অন্যতম এক নেতা বলেন, ‘কক্সবাজারের আইনশৃংখলা পরিস্থিতি কি তা একটি ঘটনা দেখলেই বুঝা যাবে। আর তা হলো জেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জেলা কমিউনিটি পুলিশের সভাপতি এডভোকেট রনজিত দাশ এর উপর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা। তার হামলার ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতারের জন্য জেলাব্যাপী আন্দোলন করতে হয়েছে। অথচ হামলাকারীরা চোর-ছিনতাইকারী। জেলা আওয়ামীলীগের কার্যালয়ে সভায় আমি প্রকাশ্যে বলেছি, সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারের জন্য। আওয়ামীলীগের কিছু নেতা সন্ত্রাসীদের জন্য তদবির করেন তাও আমি প্রকাশ্যে বলেছি।’

এসব এলাকার সন্ত্রাসীদের বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) কাজী মতিউল ইসলাম বলেন, ‘ওইসব এলাকার অপরাধের বিষয়ে আপনি প্রায় সময় বলেন। কিন্তু কেউ অভিযোগ নিয়ে আমার কাছে আসেনা। কোন কোন স্পটে অপরাধ হচ্ছে তা আমাকে দেয়ার ব্যবস্থা করেন আমি ব্যবস্থা নেব। এছাড়া এসব অভিযোগ তারা আপনাদের বলে, কিন্তু আমাদের বলে না। সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।’ এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষন করা হলে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তোফায়েল আহমদ বলেন, ‘অপরাধের তথ্যগুলো আমাকে দেয়ার ব্যবস্থা করবেন, আমিই ব্যবস্থা নেবো।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন