‘পার্বত্য চট্টগ্রাম: সবুজ পাহাড়ের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হিংসার ঝর্ণাধারা’

fec-image

দীপিকা চাকমার বাড়ি খাগড়াছড়ি। মেয়েটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লোক প্রশাসন বিভাগে পড়ে। ক্যাম্পাসে সহপাঠীদের তার এলাকার সৌন্দর্য, সংস্কৃতি, জনবৈচিত্র্য প্রভৃতির গল্প গর্বভরে শোনাতো। বিশেষ করে, সাজেকের গল্প, মেঘের গল্প, উঁচু পাহাড়ের গল্প, কাপ্তাইয়ের নীল জলরাশির গল্প, পাহাড়ী খাবার, পোশাক, সংস্কৃতির গল্প শুনে সহপাঠিদের খুব আগ্রহ জন্মে পাহাড়ের এই সৌন্দর্য দেখার। সবাই মিলে বিভাগীয় শিক্ষকদের জানায়, তারা পাহাড় দেখতে যাবে। সেখানকার মানুষের সরল জীবনযাপন দেখবে। শিক্ষকরাও আপত্তি করেন না।

অবশেষে লোক প্রশাসন বিভাগের প্রভাষক মারুফ হাসান রুমির নেতৃত্বে ৪০-৪৫ জনের একটা টিম সাজেকের পথে বেরিয়ে পড়ে। দীপিকা চাকমার আনন্দ আর ধরে না। তার বন্ধুরা যাবে তার এলাকায়, শৈশবের স্মৃতি বিজড়িত এলাকা দেখাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীদের। সে বাড়িতে বাবা-মাকে বলে রেখেছে, তার বন্ধুরা আসছে। বাবা-মা ও পরিবারের সদস্যরাও ভীষণ খুশি হয়।

৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ খাগড়াছড়ি থেকে সাজেকের পথে তারা সার্জেন্ট কামাল চত্বরে সাময়িক বিরতি নেয়। এ সময় দীপিকা তার বন্ধুদের কাছে পাহাড়ের গল্প বলছিল। শৈশব, কৈশোর ও তারুণ্যে দেখা পাহাড়ের নানা গল্প তার মুখে বন্ধুরাও ব্স্মিয় ও ঘোর লাগা মনযোগে শুনছিলো। কিন্তু তারা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি যে, সাজেকের পথে তাদের ফলো করছিল পাহাড়ে হিংসা, বিদ্বেষ ও বিভেদ ছড়ানো একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সহযোগীরা। কেননা, বাঙালি ছেলেদের পাশে বসে কোনো পাহাড়ি মেয়ের এমন গল্প বলা তাদের কাছে অত্যন্ত আপত্তিকর ও ক্ষমাহীন অপরাধ। কোনো পাহাড়ি মেয়ে বাঙালি ছেলের সাথে গল্প করলে তাকে মারধোর করার শাস্তি দেয়া হয়, প্রেম করলে হত্যা করা হয়, বিয়ে করলে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়। কখনো নিলামে তুলেও ধর্ষণ করা হয়। এগুলো তাদের শাস্তি, যার শিকার হয়েছে শত শত পাহাড়ি মেয়ে। দীপিকাও জানতো সেটা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের সঙ্গে সমন্বিত আলাপও যে এদের কাছে দোষণীয় হতে পারে সেটা বোধহয় বুঝতে পারেনি।

একসময় দীপিকাকে চ্যালেঞ্জ করে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের সহযোগী ছেলেগুলো। বাঙালি ছেলেদের সাথে তার এতো গল্প কিসের জানতে চায় তারা! বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের সামনে এমন প্রশ্নে চরম বিব্রত ও অপমানিত হয় মেয়েটি। বন্ধুকে অপমানের হাত থেকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসে বাঙালি সহপাঠীরাও। শুরু হয় তর্ক-বিতর্ক, যা এক সময় হাতাহাতিতে রূপ নেয়। দীপিকা তার গোত্রের ছেলেদের বোঝানোর চেষ্টা করে, তারা যা ভাবছে বিষয়টি তেমন নয়। এরা তার স্রেফ সহপাঠী। আর কিছু নয়। সে তাদের সাথে পাহাড়ের গল্প করছিলো। কিন্তু তার কথা শোনার মতো পর্যায়ে ছিলো না পাহাড়ি যুবকগুলো। তারা দেশীয় অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে দীপিকাকে উঠিয়ে নিয়ে যায়।

চোখের সামনে এভাবে নিজেদের সহপাঠীকে অপহৃত হতে দেখে টিমে থাকা অন্য মেয়েরাও ভয়ে কুঁকড়ে যায়। পর্যটক হিসেবে আসা বাঙালি ছেলেরাও অচেনা পরিবেশে ভীত, হতবাক। টিম লিডার প্রভাষক মারুফ হাসান রুমি কী বলবেন, কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। শুধু ভাবছেন, সঙ্গে থাকা অন্য ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে নিরাপদে ফিরতে পারবেন তো! ডিপার্টমেন্টে কী জবাব দেবেন!! মারুফ হাসানের মনে পড়ে, টিএসসিতে একটি অনুষ্ঠানে তার সিনিয়র সহকর্মী প্রফেসর মেজবাহ কামাল ও প্রফেসর রুবায়াইয়াত ফেরদৌসের দেয়া বক্তব্য। সেই বক্তৃতায় তারা পাহাড়ের মানুষের যে সহজ ও সরলতার কথা তুলে ধরেছিলেন- তাতে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু এই কি সেই সহজ সরলতার নমুনা? বাস্তবতার সাথে কত অমিল!

অন্যদিকে, সবাই মিলে ততক্ষণে আলোচনা শুরু করেছে, এ কোন পাহাড়! এর কথা তো তারা কখনো শোনেনি। কারো কারো স্মৃতিতে তখন ভাসছে আলোচিত সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদের একটা বইয়ের নাম: ‌’পার্বত্য চট্টগ্রাম: সবুজ পাহাড়ের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হিংসার ঝর্ণাধারা’

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: পার্বত্য চট্টগ্রাম, প্রবাহিত, সবুজ পাহাড়
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন