কেএনএফের হামলা এবং পরিস্থিতি উত্তরণে করণীয়

fec-image

বান্দরবানের সবুজ পাহাড়ের মধ্য দিয়ে আবার বইছে হিংসার ঝরনাধারা। গত মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার বান্দরবান জেলায় কেএনএফ বা কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এতে সীমান্তসংলগ্ন ও সংঘাতপ্রবণ এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতাও সামনে চলে এসেছে।

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, ২ এপ্রিল মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর রুমা উপজেলায় সোনালী ব্যাংকে হানা দেয় কেএনএফ। এ সময় তারা পুলিশ ও আনসার বাহিনীর ১৪টি অস্ত্র এবং ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক নেজামউদ্দিনকে তুলে নিয়ে যায়। ১৬ ঘণ্টা না যেতেই ৩ এপ্রিল দুপুরে একই সশস্ত্র গোষ্ঠী থানচি উপজেলার কৃষি ও সোনালী ব্যাংক থেকে প্রায় ১৭ লাখ টাকা লুট করে। পরদিন ৪ এপ্রিল রাত সাড়ে ৮টার দিকে থানচি থানা লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে কেএনএফ।

এই তিন হামলার ঘটনা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রথমত, কেএনএফের সঙ্গে বান্দরবানের শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির দফায় দফায় আলোচনা চলছিল। এমন পরিস্থিতিতে তারা কেন শহরের ভেতরে এ ধরনের আক্রমণ পরিচালনা করল? দ্বিতীয়ত, রুমা ও থানচিতে কি নিরাপত্তা শৈথিল্য ও গোয়েন্দা ব্যর্থতা ছিল?

ইতিহাস বলে, পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন যখনই অভ্যন্তরীণ চাপে পড়ে, তখনই নিজেদের গুছিয়ে নিতে ‘সফট টার্গেট’ বেছে নেয়। শান্তি আলোচনার আড়ালে কেএনএফ কি নিজেদের অবস্থান সংহত করার সময় নিয়েছে? এরপর অর্থ সংগ্রহে মনোযোগী হয়েছে? দায়িত্বশীল মহলের উচিত ছিল আলোচনার পাশাপাশি শতভাগ সতর্কতা বজায় রাখা। রুমায় কেএনএফ সদস্যরা শত শত রাউন্ড গুলি করলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে একটি গুলিও বের হয়নি। বরং কেএনএফ ১৪টি অস্ত্র কেড়ে নিয়েছে। তার মানে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অপ্রস্তুত ছিল?

ঘটনাগুলোকে নিছক ‘ব্যাংক ডাকাতি’ বা ‘আইনশৃঙ্খলার বিষয়’ হিসেবে দেখা উচিত হবে না। এর মধ্য দিয়ে কেএনএফ একটি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। এর নেপথ্যে তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, আন্তর্জাতিক সংযোগ ও ত্রিদেশীয় ভূরাজনৈতিক সম্পর্ক গভীর অভিনিবেশ সহকারে দেখতে হবে। গোষ্ঠীটির রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও সামরিক শক্তি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকলে ভবিষ্যতে আরও বড় আকারে বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এ জন্য গোয়েন্দা কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বাড়াতে হবে।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই পরিস্থিতিতে করণীয় কী? বিষয়টি মূলত রাজনৈতিক। এর সামরিক সমাধান কাম্য নয়। তবে কেএনএফের বিদ্রোহ যে স্তরে পৌঁছেছে, তা দমনে সামরিক অভিযান জরুরি। আশা করি, পেশাদারিত্ব, উপযুক্ত রণকৌশল ও অস্ত্র সরঞ্জামাদি, একই সঙ্গে তেজোদীপ্ত ও মানবিক বোধসংবলিত অভিযানের মাধ্যমে বান্দরবানে শান্তি ফিরে আসবে।

উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে অভিযান পরিচালনার প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর রয়েছে। চলমান অভিযান অধিকতর কার্যকর করতে হলে এটি সেনাবাহিনীর সার্বিক দায়িত্বে করা যেতে পারে। সামরিক অভিযানের পাশাপাশি অস্ত্র সরবরাহ, অর্থ, বৈদেশিক সাহায্য ও জনসমর্থন থেকে কেএনএফকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন। না হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

কেএনএফের কিছু দিক ও বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত জানতে হবে; মোটিভেশন, অর্থ সরবরাহ, রিক্রুটমেন্ট, প্রশিক্ষণ, অস্ত্র ও গোলাবারুদের উৎস, টেকনোলজি, আইইডি, নেতৃত্ব কাঠামো, দেশি-বিদেশি সংস্থার যোগাযোগ ইত্যাদি। জাতীয় সুরক্ষা ও নিরাপত্তা প্রচেষ্টার সঙ্গে স্থানীয় গোয়েন্দা সংহতকরণ প্রয়োজন। সীমান্তের ওপারের সশ্রস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে কেএনএফের যোগাযোগ ও অস্ত্রপ্রবাহ ঠেকাতে সীমান্ত নিরাপত্তাও জোরদার করা গুরুত্বপূর্ণ।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শান্তি আলোচনা ভেস্তে গেলেও সরকারের উচিত হবে সংলাপের জন্য উন্মুক্ত থাকা। পার্বত্য চট্টগ্রামের বমসহ অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা বোঝা ও সম্মান করার প্রচেষ্টা টেকসই শান্তি নিশ্চিত করতে পারে। একই সঙ্গে মৌলিক চাহিদা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন কর্মসূচি সুচারু বাস্তবায়ন জরুরি।

বান্দরবানের দুর্গম অঞ্চলে খাদ্য সংকট, পানির সমস্যা, রোগের প্রাদুর্ভাব, ভূমি দখল ও বসতি উচ্ছেদের কথা দু-তিন বছর ধরে সংবাদমাধ্যমে আসছে। এসব ক্ষেত্রে নজর দেওয়ার পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি কৌশলও বিবেচনা করা উচিত।

লক্ষ্য রাখতে হবে, যে উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের যেন ক্ষতি না হয়। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। প্রাইভেট কোম্পানি, বহুজাতিক কোম্পানিসহ কিছু মহলের অনুন্নয়ন প্রকল্পে কৃষিজমি অধিগ্রহণ ও ইজারা বন্ধ করা উচিত। অপরিকল্পিত পর্যটনশিল্পও ক্ষতিকারক হতে পারে। মনে রাখতে হবে অনেক নৃগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা ও সংস্কৃতি পাহাড়, বন, নদীনির্ভর। তাদের জীবন-জীবিকা, সংস্কৃতি, অধিকার সমুন্নত থাকলে কেএনএফের মতো কোনো গোষ্ঠীর পক্ষে অন্যায় প্রভাব বিস্তার সহজ হবে না।

আমরা জানি, ২০২২ সালের এপ্রিলে আত্মপ্রকাশের পর কেএনএফ রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি এবং বান্দরবান জেলার রুমা, রোয়াংছড়ি, থানচি, লামা ও আলীকদম– এই ৯টি উপজেলা নিয়ে পৃথক স্বায়ত্তশাসিত রাজ্যের দাবি তোলে সামাজিক মাধ্যমে। নাথান বম হলেন এই সংগঠনের প্রধান। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের স্নাতক।

ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশের কুকি, ভারতের মিজো ও মিয়ানমারের চিন নিজেদের একই নৃগোষ্ঠী মনে করে। নৃবিজ্ঞানিরা এই তিন জাতিগোষ্ঠীকে একত্রে ‘জো’ অভিহিত করেন। এই ‘জো’ জাতীয়তাবাদও বর্তমানে বেশ আলোচিত। বাংলাদেশে কুকি সম্প্রদায়ের বিভিন্ন শাখা বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, ম্রো ও খুমি নামে পরিচিত। কেএনএফ সংগঠনটি মূলত বম জনগোষ্ঠীনির্ভর (জনসংখ্যা প্রায় ১৩ হাজার) হলেও তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের মূলত খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী ৬টি জাতিগোষ্ঠীর (মোট জনসংখ্যা প্রায় ৪২ হাজার) প্রতিনিধিত্ব দাবি করে। যাহোক, নৃতাত্ত্বিক সংযোগের জন্যই ভারতের মণিপুর, মিজোরাম ও মিয়ানমারের চিন প্রদেশের ঘটনাপ্রবাহ পার্বত্য চট্টগ্রামকেও প্রভাবিত করতে পারে। কেএনএফের সশস্ত্র উত্থানের পেছনে ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর অনুপ্রেরণা ও সহানুভূতি কতখানি, তা জানা জরুরি।

কয়েক দিন পরেই পাহাড়ে নববর্ষের ঐতিহ্যবাহী উৎসব বৈসুক, সাংগ্রাই ও বিজু (বৈসাবি) উদযাপিত হবে। অথচ কয়েকশ হঠকারী ও বিভ্রান্ত বম তরুণের জন্য পাহাড়ে এমন সময় নেমে এসেছে অশান্তি। তাদের হঠকারী কর্মকাণ্ড সবচেয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে আরও বিপদে ঠেলে দিয়েছে। বম মানে বন্ধন। বম পার্টির কিছু বিভ্রান্ত তরুণ এই বন্ধন ছিন্ন করতে পারবে না। আশা করি, দিন শেষে পাহাড়ের মানুষের সঙ্গে বন্ধন আরও দৃঢ় হবে। অস্ত্র ছেড়ে শান্তির পথে হাঁটুক কেএনএফের তরুণ সদস্যরা। বারুদমাখা রণাঙ্গন নয়; গণতান্ত্রিক উপায়ে কেএনএফ তাদের সমস্যার কথা বলুক আলোচনার শান্ত টেবিলে। আমাদের কুকি-চিন গোষ্ঠীর মানুষের প্রকৃত সমস্যার দ্রুত সমাধান হোক।

পাহাড়ের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে, সবাইকে সমমর্যাদায় অভিষিক্ত করে আমরা একত্রে হাঁটব। কেউ যেন পিছিয়ে না পড়ে। বহুত্ববাদ, সম্প্রীতি ও সহনশীলতা হোক বাংলাদেশের আত্মা। উদার বাংলাদেশের বৈচিত্র্যের মধ্যে আমাদের সব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও জনজাতির সুরভিত ফুল ফুটুক। শান্তি নামুক আমাদের সবুজ পাহাড়ে।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. বায়েজিদ সরোয়ার, এনডিসি (অব.): অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: কেএনএফ, পার্বত্য চট্টগ্রাম, ব্যাংক ডাকাতি
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন