অক্টোবরে তৃতীয় দফা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়েও অনিশ্চয়তা

fec-image

চলতি মাসে ইন্টারনেট ও সেলফোন পরিষেবা সীমিত করা হয়েছে, বিভিন্ন দেশী-বিদেশী সাহায্য সংস্থার ওপরও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। এতে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে ক্লান্ত এবং উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। চলতি সেপ্টেম্বর মাসে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ অধিবেশনের পর তৃতীয় দফায় বলপ্রয়োগ ছাড়াই তাদেরকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেয়ার নানা পন্থা নিয়ে ভাবছে। যদিওবা তাদেরকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর দুটি প্রয়াস ইতিমধ্যে ভণ্ডুল হয়ে গেছে। তা স্বত্বেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে সরকার প্রস্তুত থাকলেও জাতিসংঘ সংস্থা-এনজিও কারো কোন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। তাই আগামী অক্টোবর মাসে সম্ভ্যব্য রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আবারও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

সম্প্রতি প্রত্যাবাসনের ছাড়পত্র পাওয়া মমতাজ বেগম (২৬) নামে এই নারী সাক্ষাৎকারে বলেন আর মিয়ানমার ফেরত যাবেন না। কারণ তার স্বামী শামসুল আলম ও কোলে থাকা ৩ মাসের ফুটফুটে সন্তান মোহাম্মদ রুমেনকে দেখিয়ে বলেন, কেমন করে ফিরে যাই বলুন, প্রত্যাবাসনের তালিকায় স্বামী ও সন্তানের নাম নেই। তাদের ছাড়া সেখানে গিয়ে কি করব?

এদিকে ২২ আগস্ট থেকে ১৩ দিন বন্ধের পর ৫ সেপ্টেম্বর থেকে প্রত্যাবাসনের ছাড়পত্র পাওয়া রোহিঙ্গাদের আবারও সাক্ষাৎকার শুরু হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১২ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত ৪২৩ পরিবার ছাড়পত্র পাওয়া রোহিঙ্গার সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে। বুধবার ১ পরিবার আসলেও বৃহস্পতিবার কোনো রোহিঙ্গা সাক্ষাৎকার দিতে আসেনি বলে জানা গেছে। কিন্ত এ পর্যন্ত কোনো রোহিঙ্গা স্বেচ্ছায় মিয়ানমার ফিরে যাওয়ার আগ্রহ দেখায়নি।

সাক্ষাৎকার গ্রহণস্থল শালবাগান ২৬-নং ক্যাম্পের সিআইসি উপসচিব মোং খালেদ হোসেন বলেন, রোহিঙ্গারা যা বলছে সবই শেখানো কথা।

গত ২০, ২১ ও ২২ আগস্ট টেকনাফের শালবাগান শরণার্থী শিবিরে তৈরি করা বিশেষ বুথে ইউএনএইচসিআর এবং আরআরআরসির কর্মকর্তারা প্রত্যাবাসনে তালিকাভুক্ত ৩৩৯টি পরিবারের সাক্ষাৎকার নেন। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ২২ আগস্ট ৩ হাজার ৫৪০টি পরিবারের মধ্য থেকে প্রত্যাবাসন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রোহিঙ্গাদের অনীহার কারণে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দ্বিতীয়বারের মত স্থগিত হয়ে যায়। প্রত্যাবাসনের তালিকাভুক্তদের মধ্যে শুধু শালবাগান রোহিঙ্গা শিবিরে ৯৩৩ পরিবারের ৩ হাজার ৪৫০ জনের নাম রয়েছে।

প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া শুরু হলে কিছু মহলের শেখানো মতে রোহিঙ্গারা একই সুরে নানা শর্ত জড়িয়ে দিতে থাকে। যেমনটি আগের সাক্ষাৎকারেও রোহিঙ্গারা নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা এবং গণহত্যার বিচার চেয়েছেন। একই সঙ্গে নিজেদের ফেলে আসা সম্পত্তির অধিকার এবং ক্ষতিপূরণ প্রদানের দাবি করছে রোহিঙ্গারা। সাক্ষাৎকার নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

চাকমারকুল ক্যাম্পের রোহিঙ্গা আলি জোহার, বালুখালী-২ ক্যাম্পের হাফেজ আবদুস সোবহান বলেন, যতক্ষণ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনা যাবে না ততক্ষণ প্রত্যাবাসন করা জটিল হবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ও উখিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার ফেরত পাঠানোর দায় কি শুধু বাংলাদেশের। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, দেশি বিদেশি এনজিওগুলোর কি এ বিষয়ে কোনো দায় দায়িত্ব নেই! এ পর্যন্ত এদের কেউ কোনো রোহিঙ্গাকে ফেরত যেতে একটি বারও বলেনি। কারণ রোহিঙ্গারা ফিরে গেলে ওদের বিলাসিতা বন্ধ হয়ে যাবে। রোহিঙ্গাদের ফিরে যেতে উৎসাহ যোগাতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সমম্বয়ে ক্যাম্প ভিত্তিক কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেন তিনি

রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পেলে ফিরে যেতে রাজি আছেন। ক্যাম্পগুলোতে বিছিন্নভাবে প্রত্যাবাসন তালিকা প্রস্তুতের পরিবর্তে পাড়া ও গ্রাম ভিত্তিক তালিকা তৈরি করে সে অনুযায়ী ফেরত নেওয়া হলে তাদের জানমালের নিরাপত্তায় কিছুটা ভরসা থাকে। কারণ আরসার সিদ্ধান্তের বাইরে ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গারা ফেরত গেলে জানমালের হুমকি রয়েছে।

তবে রোহিঙ্গারা বলছে, যাদের নাম আসছে না তারা হয়ত নাম ঠিকানা ভুল দিয়েছে। আর বাংলাদেশে এসে অন্তত ৪৫/৫০ হাজারের মত বিয়ে হয়েছে ক্যাম্পগুলোতে। ফলে বাংলাদেশ থেকে যে তালিকা মিয়ানমার পাঠানো হচ্ছে তার সঙ্গে মিয়ানমারের কাছে থাকা পারিবারিক তালিকার কোন মিল খুঁজে পাওয়া যাবেনা। তাই প্রত্যাবাসন তালিকা করার সময় এসব বিষয় গুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে বলে রোহিঙ্গারা জানান।

১৯৭৮ ও ১৯৯৩ সনের মত ফেরত যাওয়া রোহিঙ্গাদের ট্রানজিট ক্যাম্পে না নিয়ে সরাসরি অভ্যর্থনা কেন্দ্র থেকে স্ব স্ব পাড়া গ্রামে যেতে দিলে ফেরত কার্যক্রম সহজ হবে বলে রোহিঙ্গারা মত দেন। রাখাইন মুসলিম, ধর্ম ইসলাম স্বীকৃতি দিয়ে ফিরিয়ে নিলে নিজ উদ্যেগে রোহিঙ্গারা তাদের ঘর বাড়ি নির্মাণ, মেরামত করে নেবে। অভ্যর্থনা কেন্দ্রে এনভিসি কার্ডের জন্য চাপাচাপি না করে কয়েক মাস পর যখন নাগরিকত্বের আবেদন করবে তখন এনভিসি কার্ড দেয়া যাবে।

নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রোহিঙ্গারা জানান, আলেকিন বা আরসা, দেশি বিদেশি এনজিও, ইউএন সংস্থাগুলো সবাই একাকার। রোহিঙ্গাদের জন্য বিভিন্ন বিলাসী প্রকল্পের নামে এসব সংস্থার কর্মীরা আয়েসি জীবন কাটাচ্ছে। পলিথিনের ছোট্ট খুপরিতে ৮/১০ সদস্যের পরিবার নিয়ে চরম দুর্ভোগে জীবন কাটাতে হয় রোহিঙ্গাদের। ওদের শান শওকত, বিলাসিতা, চাকরি হারানোর ভয়ে তারা অধিকার নিয়ে রোহিঙ্গারা মিয়ানমার ফেরত চলে যাক সেটা তারা চায় না বলে জানান।

কেননা রোহিঙ্গা সংকটের দুই বছর পার হয়ে গেছে অথচ এ সংকট সমাধান করতে তারা ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। গত দুই বছরেও ইউএন সংস্থা ও আইএনজিও গুলো রোহিঙ্গা ফেরত যাওয়ার মত কোন সহায়ক পরিবেশ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। আদৌ কোন কিছু করতে পারবে কিনা তা নিয়ে রোহিঙ্গারা সন্দিহান বলে জানান।

রোহিঙ্গারা জানান, যারা মিয়ানমারে হাট-বাজারে পর্যন্ত যেতে পারেনি সেসব রোহিঙ্গারা ক্যাম্পে লাখ লাখ টাকার মালিক। তারা এখানে সব কিছুতে নেতাগিরি করছে। ক্যাম্প গুলোতে রোহিঙ্গাদের সমস্ত দোকান পাঠ, ব্যবসা, সিএনজি, টমটমসহ সবধরনের ব্যবসা, এনজিওতে রোহিঙ্গাদের চাকরি বন্ধ করা না হলে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো কঠিন বলে তারা জানান।

উল্লেখ্য, গত ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন শুরু হলে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে প্রায় ৭ লাখেরও বেশি মানুষ। সবমিলিয়ে বাংলাদেশের একাধিক শিবিরে মিয়ানমারের ১২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে।

জানা যায়, ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার ঘটনার পর পূর্বপরিকল্পিত ও কাঠামোগত সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। হত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে নতুন করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। তাদের সঙ্গে রয়েছেন ১৯৮২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত নানা অজুহাতে নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচার জন্যে বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেওয়া আরও অন্তত সাড়ে তিন লাখ রোহিঙ্গা। সব মিলে বাংলাদেশে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে বাংলাদেশ-মিয়ানমার প্রত্যাবাসন চুক্তি সম্পন্ন হয়। একই বছরের ৬ জুন নেপিদোতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমার ও জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর মধ্যেও সমঝোতা চুক্তি হয়।

চুক্তি অনুযায়ী, গত বছরের ১৫ নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। তবে আবারও হামলার মুখে পড়ার আশঙ্কায় রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরতে অস্বীকৃতি জানানোয় ব্যর্থ হয় ওই উদ্যোগ।

সর্বশেষ চলতি বছরের জুলাই মাসে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে নতুন করে উদ্যোগের অংশ হিসেবে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করে মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিব মিন্ট থোয়ের নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধি দল। ১৫ সদস্যের দলটি দুই দিন ধরে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলোচনা ও বৈঠক করে। এসব বৈঠকে রোহিঙ্গাদের তরফে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব ও চলাফেরায় স্বাধীনতার দাবি পুনর্ব্যক্ত করা হয়।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: এনজিও, জাতিসংঘ, মিয়ানমার
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন