থাইল্যান্ডে গণকবরের ঘটনায় রামুতে স্বজনদের মাঝে উৎকণ্ঠা
খালেদ হোসেন টাপু, রামু:
নিজের ও পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তনের প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে দালালের হাত ধরে সাগরপথে স্বপ্নের মালয়েশিয়ায় অনিশ্চিত যাত্রা থেমে নেই। কিন্তু অসাধু দালালের খপ্পরে পড়ে মালয়েশিয়া যাওয়া তো দূরের কথা, দালাল চক্রের নির্যাতনের শিকার হয়ে মাঝপথে প্রাণ হারাচ্ছে ভাগ্য বিড়ম্বিত অনেক মানুষ। কারো কারো মৃতদেহ স্বজনেরা ফিরে পেলেও আবার অনেকেই চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে সাগরে। আবার অনেকেই ধরা পড়ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে।
এভাবেই ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় গত দুই বছরে কক্সবাজারের রামু উপজেলা থেকে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমিয়েছে ভাগ্য বিড়ম্বিত অন্তত ১৫ হাজার মানুষ। এরমধ্যে নিখোঁজ রয়েছে প্রায় এক হাজার। সম্প্রতি থাইল্যান্ডের গভীর জঙ্গলে দালালদের নির্যাতনে নিহতদের গণকবরের ঘটনায় রামুর বিভিন্নস্থানে নিখোঁজদের স্বজনেরা নতুন করে উৎকণ্ঠায় পড়েছে।
উপজেলার রশিদ নগর ইউনিয়নের বড় ধলিরছড়া গ্রামের আব্দুস সালামের ছেলে সেকান্দর (৩০) টেকনাফের নুরুল হক নামের এক দালালের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হয় দুই বছর আগে। এর পর থেকে আর সেকান্দারের সন্ধান নেই। সেকান্দর কি বেঁচে আছে, নাকি মারা গেছে কোনটাই নিশ্চিত হতে পারছেন না তারা। তবে থাইল্যান্ডের গণকবরের ঘটনায় এখন বেশ উদ্বিগ্ন তার বাবা-মা।
বুধবার সকালে সেকান্দরের বাড়ি গেলে এসব কথা জানতে চাইলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন সেকান্দরের মা সোনাবিবি। সোনাবিবি বলেন, দুই বছর আগে টেকনাফের নুরুল হক দালালের প্রলোভনে পড়ে বাড়ির কাউকে কিছু না বলে ছেলে টেকনাফ চলে যায়। সেখানে বোটে উঠার পর ফোন দিয়ে বলে, মা আমি চলে যাচ্ছি, আমার জন্য দোয়া করো। সেই যে গেল, দুই বছর হয়েছে, আর কোনো হদিস নেই। এখন শুনছি, থাইল্যান্ডে এরকম অনেককে মেরে ফেলা হয়েছে, আমার ছেলেও কি সেখানে মারা গেছে, নাকি বেঁচে আছে কিছুই জানিনা।
স্বামীর সন্ধান না পেয়ে চার ছেলে-মেয়ে নিয়ে বেকায়দায় আছেন সেকান্দারের স্ত্রী মোহছেনা বেগম। মোহছেনা জানান, সেকান্দর চলে যাওয়ার দুই মাস পরে ছোট মেয়েটির জন্ম হয়। এখন মোট চারজন ছেলে-মেয়ে নিয়ে খেয়ে না খেয়ে আছি। যা হবার হয়েছে, এখন আমার স্বামী জীবিত ফিরে আসুক এটাই আল্লাহর কাছে চাই।
শুধু সেকান্দর নয়, একই গ্রামের নুরুন্নবী বাদশা, মোজাম্মেল হক, রমজান আলী, নুরুল ইসলাম এবং পার্শ্ববর্তী ঈদগাঁও ইউনিয়ের মো.সেলিম, মিজান, নুরুল হুদাসহ অন্তত বিশজনের মালয়েশিয়া যাত্রার গল্প ঠিক একই রকম। এদের পরিবারের কেউই জানেনা স্বজনদের সন্ধান।
একই চিত্র পাওয়া গেল রামুর খুনিয়াপালং ইউনিয়নে। এ ইউনিয়নের দারিয়ারদীঘি গ্রামের দিন মজুর আবদুস শুক্কুরের ১৫ বছরের ছেলে হারুনর রশিদ নিখোঁজ রয়েছে গত আড়াই বছরের বেশি সময়। স্থানীয় তনু নামের এক ব্যক্তি কৌশলে তার শিশুকে নিয়ে গিয়ে টেকনাফ থেকে তুলে দেয় মালয়েশিয়া ট্রলারে। এরপর থেকে ছেলের সন্ধান না পেয়ে শোকে অনেকটা পাগল পিতা ও মা।
নিখোঁজ হারুনের বাবা আবদুস শুক্কুর জানান, তার পুত্রকে একই এলাকার কাদের হোসেনের পুত্র তনু পোষাক ক্রয় করে দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বাজারে নিয়ে যায়। এরপর ২ বছর ৮ মাসেও ছেলের সন্ধান পাওয়া যায়নি।
এ এলাকায় শুধু হারুন নয়, হারুনের মত একই এলাকার গোলাম সোবাহানের পুত্র কালু, গোলাম হোসের পুত্র ফরিদুল আলম, সোনা আলীর পুত্র ফরিদ মিয়া, নাজির হোসেনের পুত্র ফরিদুল আলম, কাদের হোসেনের পুত্র মোঃ আলম, সুলতান আহমদের পুত্র তৈয়ুব উল্লাহ, আলী আহমদের পুত্র আলম, ইসলাম মিয়ার পুত্র মুহিব উল্লাহ, আলী আকবরের পুত্র আবু সিদ্দিক, ঠান্ডা মিয়ার পুত্র কামাল হোসেন, আবুল কালামের পুত্র খাইরুল আমিনসহ অন্তত ২০ জন শিশু কিশোর দালালের প্রলোাভনের ফাঁদে পড়ে মালয়েশিয়ায় যাত্রার নামে এখন নিখোঁজ। হতভাগ্য এসব নিখোঁজ শিশু-কিশোরের স্বজনেরা জানেনা এরা কি এখন জীবিত না মৃত। এ অবস্থায় থাইল্যান্ডের গভীর জঙ্গলে সেই গণ কবরের ঘটনায় উদ্বিগ্ন এদের স্বজনেরা।
রামু উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রিয়াজ উল আলম জানান, বিভিন্নভাবে পাওয়া তথ্য মতে, গত দুই বছরের রামু উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন থেকে দালাল চক্রের ফাঁদে পড়ে সাগর পথে শিশু কিশোরসহ অন্তত ১৫ হাজার মানুষ মালয়েশিয়ার পথে যাত্রা করেছে। এদের মধ্যে নিখোঁজ রয়েছে এক হাজারেরও বেশী। তিনি বলেন, এদের মধ্যে যারা থাইল্যান্ড-মিয়ানমারে জেলে পড়েছে, এদের দেশে ফিরিয়ে আনতে, কি উদ্যোগ নেওয়া যায়, সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার নাথ জানান, থাইল্যান্ডের গণকবরে কোনো বাংলাদেশী আছে কিনা এ বিষয়ে আমার কাছে কোনো তথ্য নেই। তবে মানবপাচার প্রতিরোধে পুলিশ কঠোর অবস্থানে রয়েছে বলে জানান তিনি।