দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন

রাঙামাটিতে আওয়ামী লীগে দীপঙ্করের প্রতিদ্বন্দ্বী নিখিল কুমার চাকমা

fec-image

দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ঠিক থাকলে আগামী বছরের প্রথম দিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেই লক্ষ্যেই আওয়ামী লীগ সরকার অগ্রিম তাদের সংগঠনের কলা-কৌশল নির্ধারণ করে এগুচ্ছে, সাজাচ্ছে নির্বাচনী মাঠ। জানা গেছে, দেশের অন্যান্য এলাকার ন্যায় পাহাড়ি জেলা রাঙামাটি আসন নিয়েও আওয়ামী লীগ অগ্রিম চিন্তাধারা করছে, কাকে মনোনয়ন দিলে বিজয় সুনিশ্চিত করতে পারবে।

পাহাড়ের সবচেয়ে অভিজ্ঞ প্রবীণ রাজনীতিবিদ দীপঙ্কর তালুকদার এমপি, যিনি ৯০’র দশক থেকে রাঙামাটি ২৯৯ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে করে আসছেন। তিনি এখন পর্যন্ত রাঙামাটি আসন থেকে চারবার জাতীয় সংসদ সদস্য সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। মাঝখানে ২০০১ সালে বিএনপির সংসদ সদস্য মণিস্বপন দেওয়ান এবং ২০১৪ সালে অনিবন্ধিত সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) প্রার্থী ঊষাতন তালুকদার এর কাছে পরাজয় বরণ করেন। বর্তমানে তিনি এ আসনের এমপি। পাশাপাশি তিনি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সদস্য, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য, রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। এ সরকারের আমলে সংসদ সদস্য ছাড়াও তিনি খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। ছাত্রজীবনে তিনি সরাসরি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার পর অন্যতম প্রতিবাদী ছাত্র নেতা ছিলেন। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর প্রতিবাদ করে তিনি ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন।

রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা, সাহস, মেধা, বুদ্ধি, শিক্ষা, জ্ঞান, যশ, খ্যাতিতে রাঙামাটি আসনে আওয়ামী লীগের নির্ভরযোগ্য প্রার্থী। তিনি বঙ্গবন্ধুর তনয়া শেখ হাসিনার অন্যতম ঘনিষ্ঠজন হিসেবেও পরিচিতি। বর্ষিয়ান এ রাজনীতিবিদ বর্তমানে দ্বাদশ সংসদীয় নির্বাচনে আবারো নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে চান। দলটির ঊর্ধ্বতন নেতৃবৃন্দ এমন তথ্যই জানিয়েছেন এবং তিনিও একাদিক দলীয় সভা-সেমিনারে বলে যাচ্ছেন, দল যদি চায় তাহলে তিনি নির্বাচন করতে প্রস্তুত আছেন।

তবে অভিজ্ঞ এ নেতাও তার রাজনৈতিক পথচলায় কিছু ভুল করেছেন বলে দলের একাংশের মত। ২০২২ সালের রাঙামাটি আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে দলীয় কোন্দল প্রকাশ্যে আসে। একদিকে দীপঙ্কর তালুকদার এবং দলের সাধারণ সম্পাদক মুছা মাতব্বর; অপরদিকে সাবেক জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমার মধ্যে দলীয় কাউন্সিল নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়।

কাউন্সিলে দীপঙ্কর তালুকদারের বিরুদ্ধে সভাপতি পদে একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন সাবেক জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা। যদিও শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রের দলীয় সিনিয়র নেতৃবৃন্দদের অনুরোধে নিখিল কুমার চাকমা সভাপতি পদ থেকে সরে গেলে দীপঙ্কর তালুকদার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পুনরায় সভাপতি নির্বাচিত হন। এরপর দলটি জেলা কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার সময় দলের সিনিয়র নেতারা পদ-পদবি না পেয়ে বেঁকে বসলে দলীয় কোন্দল বড় আকার ধারণ করে। পদ বঞ্চিত এসব সিনিয়র নেতা দলের প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করেন এবং দলের নানাবিধ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেন।

এর আগে পাহাড়ের সবচেয়ে আলোচিত সরকারি প্রতিষ্ঠান পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন নিখিল কুমার চাকমা। সরকারের নিয়মানুযায়ী বোর্ডের মেয়াদ শেষ হলে নিখিল কুমার চাকমা আবারো দ্বিতীয় মেয়াদে বোর্ডের চেয়ারম্যানের পদ পেতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। কিন্তু তার এ চাওয়া পূর্ণ হয়নি। খালি হাতে তাকে ফিরতে হয়েছে। চেয়ারম্যান পদটি হাতছাড়া হওয়ার মূল কারণ হিসেবে অনেকে দীপঙ্কর তালুকদারের উপর দোষ চাপিয়েছেন। যে কারণে দলের ভেতরকার গ্রুপিং আরো শক্তিশালী রূপ ধারণ করে।

এদিকে জেলার দশটি উপজেলাতেই দলের মধ্যে গ্রুপিং এখন প্রকাশ্য রূপ ধারণ করেছে। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদীয় নির্বাচনে যে উপজেলা থেকে সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়ে আওয়ামী লীগ রাঙামাটি আসনে বিজয়ী হয়েছিলো সেই জনবহুল উপজেলা লংগদুতে দলীয় কোন্দল দীর্ঘদিনের। সেখানে ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলটির উপজেলার সভাপতি এবং উপজেলা পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান আব্দুল বারেক সরকার এবং আরেক হেভিওয়েট নেতা উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও জেলা পরিষদের সদস্য আব্দুর রহিমকে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়। এরপর থেকে দলে বিশৃঙ্খলা এবং গ্রুপিং ক্রমেই বাড়ছে ওই উপজেলায়।

এছাড়া কাউখালী, কাপ্তাই, বরকল, রাজস্থলী উপজেলাতে গ্রুপিং বিদ্যমান রয়েছে। গ্রুপিং রয়েছে জেলা কমিটি, জেলা সদর এবং জেলা শহরেও। যে কারণে বর্ষিয়ান এ নেতার শক্তি হ্রাস পেয়েছে বলে ধারণা করছেন স্থানীয় পর্যবেক্ষক মহল। অপরদিকে এমন দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নিখিল কুমার চাকমাও এগিয়ে চলেছেন।

এ ব্যাপারে দীপঙ্কর তালুকদারের মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি ওভার টেলিফোনে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।

প্রতিদ্বন্দ্বী নিখিল কুমার চাকমা নানিয়ারচর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি রাঙামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। এরপর তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। দলে তিনি সজ্জন এবং কর্মীবান্ধব নেতা হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। এক সময় দীপঙ্কর তালুকদারের হাত ধরে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত হয়েছেন। বর্তমানে দীপঙ্কর তালুকদারের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবা হয় তাকে। তিনি রাঙামাটির দাদা খ্যাত দীপঙ্কর তালুকদারকে টপকিয়ে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে ২৯৯ আসনে নির্বাচন করতে চান এবার। নিখিল কুমার চাকমা ইশারা-ইঙ্গিতে গণমাধ্যমে তার মনের বাসনা জানানোর চেষ্টা করলেও প্রকাশ্যে এ ব্যাপারে কোনো বক্তব্য বা মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তার ঘনিষ্ঠজনরা বলছেন ভিন্ন কথা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলছেন নিখিল কুমার চাকমা এইবার ২৯৯ আসনে নির্বাচন করতে আগ্রহী এবং সেই লক্ষ্যে লবিং করে যাচ্ছেন কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে। পাশাপাশি তৃণমূল দলীয় নেতাকর্মী এবং পাহাড়ের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলীয় নেতাদের সাথে তিনি যোগাযোগ রাখছেন। রাজনৈতিক ময়দানে অভিজ্ঞ দীপঙ্কর তালুকদারকে টেক্কা দিতে তিনি সব রকম প্রস্তুতি নিয়েই কাজ করছেন। দলটির একাধিক নেতা বলছেন, নিখিল কুমার চাকমা রাঙামাটি আসনে দীপঙ্কর তালুকদারের পাশাপাশি তিনিও দলের পক্ষ থেকে মনোনয়ন চাইবেন। যে কারণে দীপঙ্কর তালুকদার এবার দলীয় মনোনয়ন দৌড়ে স্বস্তিতে নেই।

রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী মুছা মাতব্বর পার্বত্যনিউজকে বলেন, দীপঙ্কর তালুকদার ছাড়া আমাদের কোনো ভাবনা নেই। তার নেতৃত্বে আমরা দ্বাদশ সংসদীয় নির্বাচনে অংশ নিতে চাই এবং বিজয়ী হতে চাই। দীপঙ্কর তালুকদারের বিকল্প যদি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ অন্য কাউকে দলীয় মনোনয়ন দেয় তার জন্য কাজ করবেন কিনা এমন প্রশ্নে দলটির সাধারণ সম্পাদক বলেন, এখনো সেই সময় আসেনি। যখন আসবে তখন দেখা যাবে।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: আওয়ামী লীগ, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন