রুমায় কেএনএফ অত্যাচারে অতিষ্ঠ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাধারণ মানুষ

fec-image

দিন যতই এগোচ্ছে ততই কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট কেএনএফ সংগঠনটি ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। কেএনএফ সংগঠনের ভয়ে আতঙ্কে রয়েছে রুমা উপজেলার চার গ্রামের সাধারণ মানুষ। অত্যাচার, জুলুম, চাদাঁবাজি, হয়রানী, মারধরসহ নানান অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের স্বীকার হচ্ছে হাজার খানেক গ্রামের মানুষ। দিন কিংবা রাতে কেএনএফ আতঙ্কে মানবেতর জীবনযাপন করছেন প্রায় ৪টি গ্রামের ১হাজার পরিবারের মারমা সম্প্রদায়ের মানুষ। তাদের থেকে রেহাই পেতে প্রশাসনের কাছে সহযোগিতা চেয়ে মেলেনি কোন সুরাহা। যার ফলে গ্রামের গৃহপালিত প্রাণী, চাউলসহ নানা খাদ্যশস্য জোরপূর্বকভাবে নিয়ে যাচ্ছে কেএনএফ সদস্যরা। সংগঠনের খাবার সংকট নিরসন করতে প্রত্যেকটি গ্রামবাসীদের উপর চালাচ্ছে অত্যাচার ও চাঁদা আদায়। গ্রামবাসীদের একটাই প্রশ্ন, কেএনএফ অত্যাচার থেকে কবে মুক্তি পাবে তারা? আর কবে বা স্বাভাবিক ভাবে জীবনযাপন করতে পারবে!

গত কয়েকদিন রুমায় স্থানীয়ভাবে অনুসন্ধান করে জানা গেছে, রুমা উপজেলার ১নং পাইন্দু ইউনিয়নের দুর্গম এলাকার অবস্থিত চাইরাগ্র পাড়া, পরোয়া পাড়া, সেগুন পাড়া ও নিয়াংক্ষ্যং পাড়া। সেসব গ্রামের প্রায় ১হাজার পরিবারের মারমা সম্প্রদায়ের বসবাস। গ্রামের দুর্গম হওয়াতেই কিছুটা কষ্ট পোহালেও বাজার পণ্য বিক্রি করে চলে সংসার। কিন্তু সেই গ্রামে বসবাসরত মানুষের কাছ থেকে পোষা প্রাণী জোরপূর্বকভাবে নিয়ে যাচ্ছে কেএনএফ সদস্যরা। শুধু পোষা প্রাণী নয়, অর্থ ও খাদ্যশস্য চাউল দাবী করছেন তারা। যার ফলে তাদের এমন কর্মকাণ্ড ও অত্যাচারের স্বীকার হচ্ছে গ্রামবাসী। তাদের অত্যাচার থেকে জানমালের নিরাপত্তা পেতে গ্রামবাসী স্মরণাপন্ন হয়েছে প্রশাসন, সেনাবাহিনী ও পুলিশের কাছে। সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে দিয়েছে অভিযোগ।

পার্বত্যনিউজ প্রতিনিধির পরিদর্শনকালে গ্রামবাসীরা জানিয়েছেন, কেএনএফ সদস্যরা কোন কিছু না বলে জোরপূর্বকভাবে গ্রামে ঢুকে একে পর এক চাঁদা দাবী করতে থাকে। শুধু চাঁদা নয়, বাড়িতে থাকা গৃহপালিত প্রাণী ধরে নিয়ে যান কেএনএ সদস্যরা। সেই সাথে গ্রামে থাকা প্রত্যেক বাড়ি থেকে খাদ্যশস্য হিসেবে তিন বস্তা চাউল ও নগদ অর্থ দিতে বাধ্য করেন। অন্যথায় গুলি করে হত্যা করতে হুঁশিয়ারি দেন তারা। তাছাড়া তাদের হুমকিতে যেতে পারছেন না নিজ এলাকায় জুম ঘরে। এতে জুমের ফলমুল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে পার্বত্যনিউজের কাছে অভিযোগ করেন গ্রামবাসীরা।

চেরাইগ্র পাড়া গ্রামপ্রধান(কারবারী) অংসিং নু মারমাসহ অনান্য গ্রাম প্রধানরা জানান, কেএনএফ সদস্যরা এসে প্রত্যেক বাড়ি থেকে ৫শত টাকা চাঁদা দাবী করেছে। টাকার পাশাপাশি প্রত্যেক গ্রাম থেকে চাউল তিনবস্তা ও গ্রামে থাকা পালিত মুরগী নিয়ে গেছেন। যদি তাদের কথা না শুনি তাহলে খুন করা হুমকি দিয়ে গেছেন। তাছাড়া আমরা নিজ জুমে কাজ করতে যেতে পারছি না। তাদের থেকে রক্ষা পেতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে।

পাইন্দু ইউপি চেয়ারম্যান উহ্লামং মারমা বলেন, গ্রামে কেএনএফ সদস্যরা এসে অত্যাচার করে চাঁদা দাবী করেছিল। পরে স্থানীয়রা উপজেলা বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছে। বর্তমান সেসব এলাকায় সেনাবাহিনী টহল চালাচ্ছে। পার্বত্যনিউজের হাতে থাকা সেসব স্মারকলিপি থেকে দেখা যায় সেখানে বলা হয়েছে, “আমরা নিম্ন স্বাক্ষরকারী আপনার উপজেলাধীন ১ নং পাইন্দু ইউনিয়ন পরিষদে অন্তর্গত, ২ নং ওয়ার্ডের চাইরাগ্র পাড়াবাসীবৃন্দ। অত্র পাড়ায় মোট ৭৫ টি পরিবারের বসবাস। যার মোট জনসংখ্যা প্রায় ৩০০ জন।

উল্লেখ্য যে, কেএনএফ (বম পার্টি) সন্ত্রাসীদল কর্তৃক গত ১৮/০৮/২০২৩ খ্রি: তারিখ রোজ সোমবার দিবাগত রাত্রি আনুমানিক ২ ঘটিকার সময় অত্র পাড়ায় আনুমানিক মোট ১০/১৫ জনের মত একটি স্বশস্ত্র দল অর্তকিতভাবে উক্ত পাড়ায় বিনানুমতিতে প্রবেশ করে পাড়াবাসীর পালিত নিজ গবাদি পশুপাখি যেমন, হাঁস, মুরগি, শুকর, কুকুরসহ বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী বিনা পয়সায় গুলি করে সন্ত্রাসী কায়দায় জোরপূর্বক নিয়ে যায়। যার আনুমানিক ওজন ৪০ কেজি/১ মনের মতো হতে পারে। তাছাড়া উক্ত পাড়া হতে প্রতিটি পরিবারের নিকট থেকে নগদ ৫০০/- (পাঁচ শত) টাকা, চাঁদা ও এক পাড়ার জন্য ৩ বস্তা চাউল দাবী করে আগামী ১ সপ্তাহের মধ্যে প্রদানের জন্য আদেশ করে। অন্যথায় উক্ত পাড়াবাসীদের প্রাণে মারার হুমকি দেয়।

এমতাবস্থায়, আমরা অত্র পাড়ার সকল সাধারণ জনসাধারণ নিজ জানমালের নিরাপত্তাসহ প্রতিটি মূহুর্ত প্রাণের ভয়ে কল সাধারণ মানবেতর জীবন যাপন করছি। যা আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় চরম ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে। তাছাড়া নির্বিঘ্নে নিজ জুম ও বাগানে যাওয়া আসার ব্যাঘাত হওয়ায় প্রচুর অর্থনৈতিক হুমকির সম্মুখীন হচ্ছি।” অন্যান্য স্মারকলিপিরও প্রায় একই ভাষা। তবে নিরাপত্তার কারণে স্মারকলিপিতে স্বাক্ষরকারীদের নাম প্রকাশ করা হলো না।

অন্যদিকে, বান্দরবানের রোয়াংছড়ি ও রুমায় মোবাইলে ম্যাসেজ দিয়ে শিক্ষকদের কাছে চাঁদা চাওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট ( কেএনএফ) এর বিরুদ্ধে। শিক্ষক ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বান্দরবানের রোয়াংছড়ি ও রুমায় ইউএনডিপি স্কুল নামে পরিচিত ৩৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করা হয়। সম্প্রতি এইসব বিদ্যালয়ের কর্মরত শিক্ষকেরা প্রতিজন প্রায় ১৪ লাখ করে বকেয়া বেতন পান। জাতীয়করণকৃত বিদ্যালয় সমুহে কর্মরত শিক্ষকের মধ্যে বম সম্প্রয়ের শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ৩০ জন। তার মধ্যে রোয়াংছড়িতে ৯ জন।

বকেয়া বেতন প্রাপ্ত ওইসব বম শিক্ষকদের কাছে মোবাইলের মাধ্যমে ম্যাসেজ পাঠিয়ে প্রতিজন শিক্ষকের কাছ থেকে ৭০ হাজার টাকা করে চাঁদা চায় কেএনএফ। দাবি করা চাঁদা টাকা কেএনএফ এর কাছে পৌঁছানো সর্বশেষ তারিখ ছিল- ২৮ আগস্ট। তবে সরেজমিনে অনুসন্ধানকালে শিক্ষকরা পার্বত্যনিউজের কাছে চাঁদার বিষয়টি স্বীকার করলেও প্রকাশ্যে কেউ বিষয়টি স্বীকার করতে চায়নি।

রোয়াংছড়ির তারাছা ইউনিয়নের জাতীয়করণকৃত বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেন, তাঁর সহকর্মীদের কাছে ওই দল ( কেএনএফ) থেকে ম্যাসেসেজ দেয়ার কথা শুনেছেন, তবে তাঁর মোবাইলে এ ধরণের কোনো ম্যাসেজ আসেনি বলে জানান এ শিক্ষক।

রুমার রেমাক্রীপ্রাংসা ইউনিয়নের চইক্ষ্যং পাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক (লালজার বম) বলেন, কেএনএফ বম শিক্ষকদের কাছে চাঁদা চাওয়া বিষয়টি কারও কাছে শুনেননি, তার কাছেও কোনো ম্যাসেজও আসেনি।

তবে বাকত্লাই পাড়ার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী এক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রতিজন শিক্ষকের কাছে ৭০ হাজার টাকা নয়, সাধ্যমত আর্থিক সহযোগিতা করতে অনুরোধ করেছিল। কে কত দিয়েছে, জানিনা। তবে তিনি কোনো টাকা এখনো দেননি বলে দাবি করেন ওই শিক্ষক।

এবিষয়ে রুমা উপজেলার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিদারুল আলম বলেন, কেএনএফ অত্যাচারে কারণে ৪টি গ্রাম থেকে স্মারকলিপি জমা দিয়েছে। বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা মিটিং এ মধ্যে উপস্থাপন করা হয়েছে। এ বিষয়ে তদন্ত করতে রুমা থানাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

রুমা থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি জানান, আমি থানায় নতুন এসেছি। এবিষয়ে আমি অবগত নয়। খোঁজ খবর নিয়ে বিস্তারিত বলা যাবে।

তবে, কেএনএফ তাদের ফেসবুক পেইজে চাঁদাবাজীর সকল অভিযোগ অস্বীকার করেছে। অন্যদিকে, কেএনএফের একটি সূত্র পার্বত্যনিউজেকে জানায়, কেএনএফকে বিতর্কিত করতে একটি গোষ্ঠী এ ধরণের অভিযোগ করছে। তার মতে, মূলত কেএনএফকে বিতর্কিত করতে জেএসএস চাঁদাবাজী করে কেএনএফের নামে চালিয়ে দিচ্ছে।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট, কেএনএ, কেএনএফ
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন