আলীকদমে ব্যবহারের ৮ মাস পর টয়লেট উদ্বোধন করলেন সিনিয়র সচিব

অনিয়ম

আলীকদম (বান্দরবান) সংবাদদাতা:
একটি পাড়ায় ১০৩টি ইকো টয়লেট নির্মাণ করে ‘শতভাগ স্যানিটেশন কভারেজ গ্রাম’ ঘোষণা করেছে সোসাইটি ফর পিপলস্ এ্যাকশন ইন চেইঞ্জ এন্ড ইক্যুইটি (স্পেস) নামের একটি বেসরকারী সংস্থা। ইউনিসেফের অর্থায়নে করা এ প্রকল্প ব্যয় নিয়েও রয়েছে গরমিল। টয়লেট নির্মাণের ৮ মাস পর উদ্বোধন করানো হয় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মনজুর হোসেনকে দিয়ে। সম্প্রতি এমন একটি প্রশ্নবিদ্ধ প্রকল্পের উদ্বোধন হয়েছে বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলার বাবু পাড়ায়।

১০৩ পরিবারের ‘পাড়া’কে কেন ‘গ্রাম’ ঘোষণা করা হলো এর সদুত্তর পাওয়া যায়নি ইউনিসেফ, স্পেস কিংবা প্রকল্পটির তত্ত্বাবধানে থাকা জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকেও। পাশাপাশি নয়াপাড়া নামে আর একটি পাড়ায় ৯৩টি টয়লেট নির্মাণ করা হয়। তবে সেটিকে গ্রাম হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি। এ প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য ইকো টয়লেট থেকে উৎপন্ন মানববর্জ্যকে কৃষিকাজে ব্যবহার করা। মানববর্জ্য কৃষিকাজে ব্যবহারযোগ্য কিনা তার কোন সদুত্তর দেননি সংশ্লিষ্টরা।

পরিসংখ্যান অফিস সূত্রে জানা গেছে, আলীকদম উপজেলার ২নং চৈক্ষ্যং ইউনিয়নের নয়াপাড়া ৫৫৩টি পরিবার নিয়ে একটি গ্রাম। বাবুপাড়া ১০৩টি পরিবার নিয়ে শুধুমাত্র একটি ‘পাড়া’। স্থানীয় ওয়ার্ড মেম্বার ফোগ্য মার্মাও জানালেন ‘বাবু পাড়া’ কোন গ্রাম নয়, এটি একটি পাড়া।

বাবুপাড়ায় স্পেস গত দু’বছরে ইকো টয়লেট তৈরী করে ১০৩টি। পাশের একটি বৃহৎ গ্রামকে নয়াপাড়াকে বাদ রেখে শুধুমাত্র একটি পাড়াকে স্যানিটেশন কভারেজ গ্রাম ঘোষণায় নানা প্রশ্ন উঠেছে। নয়াপাড়ার মধ্যে আরো একাধিক পাড়া রয়েছে। নয়াপাড়ায় পরিবার রয়েছে ৫৫৩টি।

‘পাড়া’ কে ‘শতভাগ স্যানিটেশন কভারেজ গ্রাম’ বলে উদ্বোধন করা হলেও হলেও ইউনিসেফের ওয়াশ স্পেশালিস্ট মোহাম্মদ মনিরুল করিম বলেন, ‘আমরা পাড়া হিসেবে ঘোষণা করেছি’।

আলীকদম ইউপি চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন জানান, ‘প্রচলিত অর্থে ‘বাবু পাড়া’ কোন গ্রাম নয়। এটি একটি ‘পাড়া’। ইউনিসেফের অর্থায়নে নয়াপাড়া ও বাবুপাড়ায় ৬৫৬টি পরিবারের মধ্যে ১০৩টি টয়লেট নির্মাণ করে কিভাবে শতভাগ স্যানিটেশন কভারেজ গ্রাম ঘোষণা করেছে।

এ ব্যাপারে সদুত্তর পাওয়া যায়নি প্রকল্পটির মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তা স্পেসের প্রকল্প ব্যবস্থাপক মোঃ আব্দুছ ছালাম মিয়ার কাছে। তিনি বলেন, ‘বাবু পাড়া’ গ্রাম কিনা তা সঠিক বলতে পারবেন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী, ইউনিয়ন পরিষদ কিংবা ওয়ার্ড মেম্বার। তিনি আরো বলেন, গত এপ্রিলে এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে। এ প্রকল্পের নির্মাণ কাজের তত্ত্বাবধানের কথা ছিল জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের। তাদের অপরগতায় স্পেস কাজটি বাস্তবায়ন সহযোগিতা করেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ২০১২ সালে জিওবি-ইউনিসেফের সহায়তায় স্পেস ইকো-টয়লেট প্রকল্প হাতে নেয় বাবুপাড়া ও নয়াপাড়ায়। প্রকল্পের নামকরণ হয় ‘এ্যাকশান রিসার্স অন ইকোলজিক্যাল অলটারনেটিব ইন স্যানিটেশন ইন ডিপিকাল্ট এরিয়া অব বাংলাদেশ’ ও ‘আনলকিং পটেনশিয়াল ইন স্যানিটেশন ইন ডিপিকেল্ট এরিয়া অব বাংলাদেশ এ্যাডাপটিং ইকোলজিক্যাল এ্যাপ্রোচ্’।

২০১২ সালে সেওয়া-বি প্রকল্পের আওতায় আলীকদমের নয়াপাড়া ও বাবুপাড়ায় এবং থানছির বলিপাড়া ইউনিয়নের আইলমারা পাড়ায় আটটি ক্লাস্টারে ১৫২টি ইকো-টয়লেট নির্মাণ করে। সে বছর নয়াপাড়ায় ৯৩টি এবং বাবুপাড়ায় ৫৭টি ইকো-টয়লেট নির্মাণ করে স্পেস। চলতি বছর এ প্রকল্পের আওতায় বাবু পাড়ায় আরো ৪৬টি টয়লেট নির্মাণ করা হয়। প্রতিটি টয়লেটে নির্মাণ ব্যয় দেখানো হয় ২০ হাজার টাকা। এ হারে আলীকদমে ১৫০ টয়লেট নির্মাণে ব্যয় হয় ৩০ লক্ষ টাকা। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্পেসের ডাইরেক্টর জানান, এ প্রকল্পের বরাদ্দ ছিল ৫৫ লক্ষ ৪০ হাজার ২৫০ টাকা।

এ প্রকল্পের কাজ শেষ হয় চলতি বছরের এপ্রিল মাসে। টয়লেট নির্মাণের ৮ মাস পর গত ৩০ নভেম্বর প্রধান অতিথি হয়ে এ প্রকল্পের উদ্বোধন করেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মনজুর হোসেন। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জুয়েনা আজিজ, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী খালেদা আহসান ও বাংলাদেশ ইউনিসেফের ওয়াস সেকশনের প্রধান মি. চার্লিসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারা। এ প্রকল্প উদ্বোধনে জনপ্রশাসন, পাবলিক হেলথ, ইউনিসেফ ও স্পেসের পদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত হলেও প্রকল্পের কার্যক্রম রয়েছে স্থানীয়দের ভিন্নমত।

এ প্রকল্প থেকে উৎপন্ন মানববর্জ্য আদৌ স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিবেশ বান্ধব কিনা তা নিয়ে রয়েছে নানামত। উপজেলা স্বাস্থ্য ও প.প. কর্মকর্তা জানান, এটি ব্যবহারের পূর্বে আরো গবেষণা প্রয়োজন।

তবে এ সার স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিবেশবান্ধব কিনা, জনমনে সংশয় দেখা দেওয়ায় জানতে চাওয়া হলে সিনিয়র সচিব মনজুর হোসেন সাংবাদিকদের সরাসরি উত্তর না দিয়ে সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন। পরে এ প্রশ্নের উত্তরে ইউনিসিফের ওয়াশ স্পেশালিস্ট মোহাম্মদ মনিরুল আলম বলেন, ‘সরকারের তত্ত্বাবধানে থাকা আইসিডিআর থেকে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, মানববর্জ্যে ক্ষতিকর কিছুই নেই। এ বিষয়ে আমাদের রিপোর্ট আছে’। তিনি সাংবাদিকদের উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেন, ‘ইন্ডিয়ার একজন প্রাইম মিনিস্টার ইউরিন খেতেন’!
এ বিষয়ে স্পেসের প্রকল্প ডাইরেক্টর মোঃ আজহার আলী প্রামাণিক জানান, পাড়া কিংবা গ্রাম যাই হোক না কেন, এখানে বড় পাওয়া হচ্ছে শতভাগ স্যানিটেশন কভারেজ হচ্ছে। স্পেস নিজেদের জন্য নয় এলাকার উন্নয়নের জন্য কাজটি বাস্তবায়ন করেছে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন