টেকনাফ বাজারে ইলিশ নেই: পাচারের অভিযোগ

মুহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান, টেকনাফ:

টেকনাফ বাজারে ইলিশ শূন্য। সাগরে প্রচুর পরিমাণে ইলিশ ধরা পড়ার খবরে মানুষ আশান্বিত হয়ে বাজারে গিয়ে নিরাশ হয়ে ফিরে আসছেন। বেশি দাম দিয়েও মনের মতো ইলিশ মাছ কিনতে পারছেন না কেউ। প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, টেকনাফ থেকে গাড়িযোগে ইলিশ পাচার হচ্ছে ঢাকার উদ্দেশ্যে। ফলে তাদের পাতে ইলিশ পড়ছে না। বর্তমানে চলছে ইলিশের ভরা মৌসুম। ভাদ্র, আশ্বিন ও কার্তিক মাসে প্রচুর পরিমাণে ইলিশ সাগরে ধরা পড়লেও সব ইলিশ থাকছে না টেকনাফে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইলিশ চলে যাচ্ছে ঢাকার দিকে।

ইলিশ মাছ পাচার কাজে সহযোগিতা করছে স্থানীয় প্রশাসন, অসাধু ব্যবসায়ী এবং জলদস্যুরা। ইলিশ ধরার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ট্রলারের মালিক, জেলে, খুচরা ও পাইকারি ইলিশ বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। মাছ ধরার নৌকা, ট্রলার এবং জেলেদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদান করা গেলে ইলিশের দাম আরো কমতো বলে তারা জানান। বর্তমানে টেকনাফে পুরোদমে ইলিশ ধরা পড়ছে। সমুদ্রে ধরা পড়া সব ইলিশ যদি এ অঞ্চলে থাকতো তবে ইলিশের দাম আরো কমতো বলেও জানিয়েছেন টেকনাফ বাজারের পাইকারি ইলিশ বিক্রেতারা। এ মাছ বাংলাদেশ ঘুরে ভারতও পাচার হয়ে যাচ্ছে। অথচ গত বছর জুলাই মাসে ২৫০ মেট্রিক টন ইলিশ আমদানি করা হয়েছিল ।

অন্য বছর এ সময়ে বাজারে যে পরিমাণ ইলিশ থাকে এবার তার মাত্র ১০ শতাংশ আছে। তাও বেশির ভাগ চোরাইপথে মিয়ানমার থেকে আসা। মাছ সংকটের কারণে দামও আকাশ ছোঁয়া। যা কেজি প্রতি ৫০০ টাকা থেকে এক হাজার ১৫০০ টাকা। স্থানীয় সূত্র আরও জানায়, বাজারে যে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে তা সদ্য ধরা না। এসব মাছ হিমায়িত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ইলিশ রপ্তানি বিষয়ে টেকনাফ উপজেলা মৎস্য অফিসার সৈয়দ হুমায়ুন মোর্শেদ জানান, গত বছর সেপ্টেম্বর থেকে ইলিশ রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে মানুষের মাঝে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে ইলিশ যাচ্ছে কোথায়। গতকাল রবিবার টেকনাফের বিভিন্ন বাজারের খবর নিয়ে জানা গেছে, মাছ ব্যবসায়ীদের কারও কাছে পর্যাপ্ত ইলিশ নেই। যা আছে তা জাটকার মতো আকারে একেবারে ছোট। ৩০০ গ্রাম থেকে সর্বোচ্চ ৫০০ গ্রাম ওজনের এই ইলিশের দাম কেজি প্রতি ৬০০ টাকা থেকে ৭০০ টাকা।

ব্যবসায়ীরা ৯০০ গ্রাম বা এক কেজি ওজনের মাছের দাম এক হাজার টাকার ওপরে হাকলেও দিতে পারছেন না। স্থানীয় একটি সূত্র অভিযোগ করেছে, সাগরে প্রচুর পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়লেও তা সাগর পথেই পাচার হয়ে যাচ্ছে। সূত্রে আরো জানা যায়, মংলা বন্দরে আসা বিদেশি জাহাজ পণ্য খালাসের পর ইলিশ বোঝাই করে নিয়ে যায়। এ জন্য এই এলাকার হাট-বাজারে ইলিশ আসছে না ফলে ট্রাক ভর্তি হয়ে পাচার হচ্ছে। টেকনাফ লামার বাজারের ফারুক ফিশিং স্বত্তাধিকারী মোঃ ফারুক জানান, টেকনাফ বাজারে সাধারণত মিয়ানমার ও বঙ্গোপসাগরের জালে ধরা থেকে ইলিশ আসে। তা দিয়ে মহাজনদের চাহিদামত অনুযায়ী মাছ সরবরাহ করতে পারছেন না। মাছ যা আসে তা মহাজনের জন্য পাঠিয়ে দিতে হয়। এ কারণে টেকনাফে ইলিশের সংকট সৃষ্টি হয়েছে।

পাইকারি ইলিশ বিক্রেতা ও আড়তদার হাসান আহমদ বলেন, আমরা জাতি হিসাবে খারাপ, আমরা যদি ঝাটকা না ধরি এবং চোরাই পথে ইলিশ বিক্রি না হয় তবে এ অঞ্চলের মানুষ আরো কম দামে ইলিশ খেতে পারতো। এছাড়া জলদস্যুদের কবল থেকে জেলেরা মুক্তি পেলে বেশি পরিমাণে ইলিশ সাগরে ধরা পড়তো। ইলিশ পাচার প্রসঙ্গে আড়তদার মোঃ হোছন বলেন, সরকারিভাবে কোনো বাধা নাই। ইলিশ দেদারছে ইলিশ পাচার করা যায়। তিনি আরো বলেন, জলদস্যুদের জন্য আমাদের জেলেরা মাছ ধরতে পারে না। কারণ একটি ট্রলারের দাম ১০ লাখ টাকা। এর সঙ্গে ৩ ৭ থেকে ১০ লাখ টাকার জাল প্রয়োজন। জেলেদের ধরে নিয়ে গিয়ে মুক্তিপণ আদায় করা হয়। মুক্তিপণ না দিলে ট্রলার, জাল ও মাছসহ বাইরের দেশে নিয়ে যাওয়া হয় বা দেশের বাইরে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। জলদস্যুদের হাতে অনেক মাঝি নিঃস্ব হয়ে গেছেন। ঋণের বোঝা টানতে হচ্ছে অনেককে। তিনি বলেন, তারা (জলদস্যু) ট্রলার প্রথমে ধরে বলে অমুক দ্বীপ আছি। এরপর আবার জায়গা পরিবর্তন করে থাকে। এক থেকে দুই লাখ টাকা চেয়ে বসে। আমি এই টাকা দিতে পারিনি সেই জন্যে আমার ট্রলার ও জাল কোথায় নিয়ে গেছে বলতে পারব না।

এদিকে টেকনাফ উপজেলার বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে অবৈধভাবে মিয়ানমারে পাচার হচ্ছে দেশীয় পুকুরের মাছ। যদিও এতদিন মিয়ানমারে পাচারের তালিকায় ছিল তেল, সার, ডিম, আদা, রসুন, পেয়াঁজ, সবজি ও প্লাষ্টিক সামগ্রী। কিন্তু সম্প্রতি পাচারের তালিকায় সংযুক্ত হয়েছে মিঠাপানির পুকুরের মাছ। সম্প্রতি বিজিবির অভিযানে মিয়ানমারে পাচারকালে বিপুল পরিমাণ পাঙ্গাস মাছ জব্দ হয়। এমনকি মংডুর বাজারে এখন বাংলাদেশী তেলাপিয়া, পাঙ্গাস মাছে সয়লাব। মাছে ভাতে বাঙ্গালী বর্তমানে অতীত হলেও স্থানীয় কিছু মানুষ ব্যক্তি উদ্যোগে পুকুরের মিঠা পানিতে স্থানীয়দের চাহিদার কথা চিন্তা করে কিংবা লাভের আশায় ব্যাপক আকারে পাঙ্গাস ও তেলাপিয়া মাছের চাষ শুরু করে। যা স্থানীয় বাজারের মাছের চাহিদা পূরণ করতো। বাজারের সাগরের মাছের যা দাম তাতে গরীব ও মধ্যবিত্তদের বাজারে মাছের চড়া দাম শুনলে চোখ কপালের পরিবর্তে মাথায় উঠে যেত। সেখানে স্থানীয়ভাবে চাষ করা এ মাছগুলো কিছুটা চাহিদা পূরণ করে আসছে। কেননা, এ মাছের মূল্য তুলনামূলক কম।

সম্প্রতি মিয়ানমারে টেকনাফ উপজেলার বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে অবৈধভাবে দেশীয় মাছ পাচার হওয়ায় স্থানীয় তা ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। এতে চরম বিপাকে পড়েছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা। এমনিতে মিয়ানমারে প্রতিনিয়ত পাচার হচ্ছে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস ও খাদ্যসামগ্রী। এতে স্থানীয় বাজারে জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বাড়ছে। এতে নিম্ন আয়ের মানুষের সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। বেশকিছু দিন আগে টেকনাফের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে মিয়ানমারে অবৈধভাবে পাচারের তালিকায় শীর্ষে ছিল ডিম। বিভিন্ন গনমাধ্যম ও পত্রপত্রিকায় এ ব্যাপারে ধারাবাহিকভাবে সংবাদ প্রকাশিত হলে প্রশাসনের কিছুটা টনক নড়ে এবং ধরপাকড় শুরু করে। এতে চোরাকারবারীরা কিছুটা বেকায়দায় পড়ে স্থলবন্দর হয়ে বৈধভাবে ডিম রপ্তানি শুরু করে। এর ফলে টেকনাফের বাজারে ডিম সংকটের পাশাপাশি মূল্য বৃদ্ধি পায়। এসময় পুকুরের মাছও মিয়ানমারে অবৈধভাবে পাচার হওয়ায় স্বল্প আয়ের মানুষ মাছের দাম নিয়ে শংকিত হয়ে পড়েছে। এটাও রুই, চাঁন্দা, ইলিশের মত গরীবের ক্রয় করার ক্ষমতার বাইরে চলে গেল।

প্রাপ্ত সূত্রে জানা যায়, হোয়াইক্যং, উলুবনিয়া, লম্বাবিল, উনছিপ্রাং, কানজরপাড়া, মিনা বাজার, খারাংখালী, ঝিমংখালী, নয়াবাজার, মৌলভিবাজার, হোয়াব্রাং, নাটমুরাপাড়া, চৌধুরীপাড়া, জাদিমুরা, দমদমিয়া, কেরুনতলী, নাইট্যংপাড়া, কায়ুখখালী ঘাট, জালিয়াপাড়া, মৌলভিপাড়া, নাজিরপাড়া, সাবরাং মগপাড়া, নয়াপাড়া, জালিয়াপাড়া, বাজারপাড়া, মিস্ত্রিপাড়া ও ঘোলাপাড়া এলাকা দিয়ে প্রতিদিন শত শত কেজি পুকুরের মাছ মিয়ানমারে অবৈধভাবে পাচার হচ্ছে। টেকনাফ উপরের বাজারের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মোঃ আমিন আক্ষেপ করে বলেন, বাজারে ইলিশ, রূপচাঁদা, কোরাল, তাইল্ল্যা ও ভুল মাছের মত দামী ও সুস্বাদু মাছগুলো কখন কিনে ছিলাম তা এখন মনে করতে পারছিনা।

বর্তমান মাছের বাজারের এসব মাছের দাম শুনলে হতবাক হতে হয়। বর্তমানে ভরসা হিসেবে পাঙ্গাস ও তেলাপিয়া ছিল আমাদের একমাত্র ভরসা। মিয়ানমারে পাচার হওয়ায় এখন স্থানীয় বাজারে এসব মাছও সহজে দেখা মিলছেনা। এব্যাপারে মাছ বিক্রেতাদের কাছে জানতে চাইলে মাছ আসছে না বলে জানান। বর্তমানে বাংলাদেশে যে হারে জিনিসপত্রের দ্রব্যমূল্য উর্ধ্বগতি শুরু হয়েছে, তাতে মানুষের দুমুটো ভাত জোগার করতে কষ্ট হচ্ছে। এসময় স্থানীয় পুকুরে চাষও মাছ মিয়ানমারে পাচার হয়ে দেশে যে কৃত্রিম খাদ্য সংকট সৃষ্টি হচ্ছে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে কঠোরভাবে তা এখনি প্রতিরোধ করতে হবে। নতুবা এ খাদ্য সংকট আকাল ধারণ করবে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন