রোহিঙ্গাদের বাংলা পাঠদান অব্যাহত: এনজিওগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ

fec-image

স্থানীয় বাংলাদেশীদের ক্ষোভ ও প্রতিবাদের পরও ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গাদের বাংলা কারিকুলামে পাঠদান অব্যাহত রেখেছে এনজিও গুলো। কার্যত বাংলা শিক্ষা প্রদান করে বাংলাদেশী নাগরিক ও উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করাচ্ছে বলে অভিযোগ এনজিও গুলোর বিরুদ্ধে। কয়েকদিনের অনুসন্ধানে সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য মিলেছে।

উখিয়ার কুতুপালং ও টেকনাফের নয়াপাড়া রেজিষ্ট্রার্ড রোহিঙ্গা ছেলে-মেয়েদের সম্পূর্ণ বাংলা কারিকূলামে পাঠদান দিয়ে যাচ্ছে এনজিও কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট সেন্টার ‘কোডেকথ। এ নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের কোন তদারকি ও জবাবদিহিতা না থাকায় ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে স্থানীয় লোকজনের মাঝে। কুতুপালং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হাবিবুর রহমান বলেন, গত বছর আমি এ স্কুলে যোগদানের পর প্রায় শতাধিক রোহিঙ্গা ছাত্র -ছাত্রীদের ভর্তি বাতিল করেছি। বর্তমানে এ স্কুলে আর কোন রোহিঙ্গা শিক্ষার্থী নেই বলে তিনি দাবি করেন।

কুতুপালং পূর্ব পাড়া গ্রামের আবুল হোসেন ও রবীন্দ্র বড়ুয়া বলেন, এ বছর কুতুপালং প্রাইমারি স্কুল থেকে রোহিঙ্গা শিক্ষার্থীদের বের করে দেয়ায় আমরা প্রধান শিক্ষককে ধন্যবাদ জানাই। পাশাপাশি কুতুপালং উচ্চ বিদ্যালয়ে এখনো অনেক রোহিঙ্গা শিক্ষার্থী অধ্যায়নে রয়েছে। স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আমাদের ছেলে মেয়েদের সাথে রোহিঙ্গা ছাত্র -ছাত্রীদের লেখাপড়ার সুযোগ না দিতে অনেকদিন ধরে দাবি করে আসছি। কিন্তু কোন কাজ হচ্ছে না বলে স্থানীয়দের ক্ষোভ রয়েছে।

উখিয়ার পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক গফুর উদ্দিন চৌধুরীর দাবি রোহিঙ্গা ছেলে- মেয়েরা যদি বাংলা শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠে তাহলে আমাদের দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। ১৯৯২ সাল থেকে উখিয়ার কুতুপালং ও টেকনাফের নয়াপাড়া ক্যাম্পে প্রায় ৩৪ হাজার রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। এ সব রোহিঙ্গাদের রয়েছে শরণার্থী মর্যাদা।

মূলতঃ এসব রোহিঙ্গাদের অধিকাংশ বাংলা শিক্ষায় শিক্ষিত হযে গড়ে ওঠছে। এদের অনেকে বাংলাদেশী এনআইডি ও পাসপোর্ট করে নিয়েছে বলে কুতুপালং এলাকার সরকার দলের নেতা নুরুল হক খানসহ অনেকে জানান। তিনি ক্যাম্পসহ স্থানীয় ও দেশের যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রোহিঙ্গাদের শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ দিয়েছে সেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানান।

এনজিও কোডেক এর রোহিঙ্গা শিক্ষা কার্যক্রমের প্রকল্প ব্যবস্থাপক জাহিদুল হক ১ম শ্রেণী থেকে ৮ ম শ্রেণী পর্যন্ত রোহিঙ্গা ছেলে মেয়েদের বাংলা ক্যারিকুলামে পাঠদানের কথা স্বীকার করেন। কুতুপালং ও নয়াপাড়া ক্যাম্পে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার অর্থায়নে কোডেক ২০টি প্রাথমিক ও ৪ টি নিন্ম মাধ্যমিক স্কুলে প্রায় ৮ হাজার রোহিঙ্গা শিক্ষার্থীদের নিয়মিত বাংলা পাঠদান করছে বলে তিনি জানান। এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও বিভাগের যথাযথ অনুমোদন থাকার দাবি করেন তিনি।

সরজমিনে কুতুপালং ও নয়াপাড়া রেজিষ্ট্রার্ড ক্যাম্পে দেখা গেছে, শিক্ষা প্রকল্পে কাজ করছে এনজিও সংস্থা ‘কোডেকথ। কুতুপালংয়ে ১০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ৩ টি নিন্ম মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। নয়াপাড়া ক্যাম্পে ৯ টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ১টি নিন্ম মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিদ্যালয়ে প্রায় ৮ হাজার রোহিঙ্গা ছেলে/মেয়েকে নিয়মিত বাংলা ক্যারিকুলামে পাঠদান দেওয়া হচ্ছে।

উখিয়া উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সুব্রত কুমার ধর বলেন পুরনো রেজিষ্টার্ড ক্যাম্প গুলোতে রোহিঙ্গা ছেলে মেয়েদের মিয়ানমার ভাষার পাশাপাশি বাংলা ক্যারিকুলামে পাঠদানের অনুমোদন ছিল। সে অনুযায়ী গত কয়েক বছর ধরে রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য চাহিদানুপাতে বই সরবরাহ করা হয়। সম্প্রতি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে আগামী ২০২০ সাল থেকে রোহিঙ্গাদের বাংলা শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ পত্র এসেছে বলে তিনি জানান।

কক্সবাজার মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ সালেহ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গাদের কোন ভাবে বাংলা শিক্ষার পাঠদানের অনুমোদন কাউকে দেওয়া হয়নি। কোন ক্যাম্পে যদি কোন এনজিও বাংলা ক্যারিকুলামে রোহিঙ্গাদের পাঠদান করে থাকে তার দায়ভার সংশ্লিষ্ট এনজিওকে নিতে হবে। মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে রোহিঙ্গাদের জন্য কোন পাঠ্যবই সরবরাহ করা হয় না বলে তিনি জানান।

এদিকে রোহিঙ্গা ছেলে/মেয়েদের বাংলা শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে এমন অভিযোগের ভিত্তিতে গত ২০১৭ সালের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. এস এম ওয়াহিদুজ্জামান ক্যাম্প পদিরর্শন করে বলেছিলেন, উখিয়ার কুতুপালং-এ নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত ক্যাম্পে বেশ কিছু এনজিও সংস্থা শিক্ষার্থীদের বাংলা পড়াচ্ছে যা বেআইনি। কোন অবস্থাতেই মিয়ানমারের শিক্ষার্থীদের বাংলা পড়ানোর সুযোগ নেই। এছাড়া মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশের কোন পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে না। বর্তমানে তা মানছেন না শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্তা-ব্যক্তিরা।

উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মোঃ রায়হানুল ইসলাম মিয়া জানান, রোহিঙ্গাদের ছেলে/মেয়ের কোন প্রকার কারিকূলাম ভিত্তিক শিক্ষা দেওয়া হচ্ছেনা, তাদের নিজস্ব তৈরি করা কাঠামোতেই পাঠদান দেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও রোহিঙ্গা শরনার্থী ত্রাণ ও প্রত্যবাসন কমিশনারের নিয়ন্ত্রিত ১টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বাংলা শিক্ষা দেওয়ার অনুমতি থাকলেও তারা কিন্তু কোন পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবেনা। বইয়ের ব্যাপারে তিনি বলেন, কোন প্রকার সরকারি বই রোহিঙ্গাদের দেওয়ার নিয়ম নেই। এরা হয়ত অন্য ভাবে ম্যানেজ করে শিক্ষা দিচ্ছে। কারণ বাজারে এখন সব ধরনের বই পাওয়া বের করেছে বিভিন্ন প্রকাশনীর।

রোহিঙ্গা ছেলে/মেয়েদের বাংলা কারিকূলামে শিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে কুতুপালং রেজিষ্ট্রার্ড ক্যাম্পের ক্যাম্প ইনচার্জ মোঃ রেজাউল করিম বলেন, রোহিঙ্গারা প্রথমে বাংলা শিক্ষা গ্রহন করতে চায়নি, আমরা জোর করে তাদেরকে বাংলা শিক্ষা দিয়েছিলাম, কিন্তু পরবর্তী যখন আমাদের ভূল আমরা নিজেই বুঝতে পেরেছি তখন বাংলা শিক্ষা দেওয়া বন্ধের উদ্যোগ গ্রহণ করি।

উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ নিকারুজ্জামান চৌধুরী জানান, রেজিষ্ট্রার্ড বা আনরেজিষ্ট্রার্ড কোন ক্যাম্পে রোহিঙ্গা ছেলে/মেয়েদের বাংলা কারিকূলামে শিক্ষা দেওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ রয়েছে। এই সংক্রান্ত অভিযোগের ব্যাপারে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নিকট প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত চেয়ে চিটি দেওয়ার কথা জানান তিনি।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: এনজিও, কোডেক, রোহিঙ্গা
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন