কী ঘটবে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ীদের ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতি দেয়া হলে?

images ববব

নাজমুল আহসান:

বেশ ক’বছর আগ থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী অধিবাসীদের ‘উপজাতি’ হিসেবে পরিচয় দিতে কোনও সমস্যা ছিল না। কিন্তু ইদানিং পাহাড়িরা নিজেরা তো ‘অপমানিত’ বোধ করছেনই, দেশের সুশীল সমাজের একটা বড় অংশ লজ্জায় মুখ দেখানোর জায়গা খুঁজে পাচ্ছেন না। বড় বিপদ বৈ কি! কিন্তু, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত হওয়া ‘শান্তিচুক্তি’তে পাহাড়ি নেতারা নিজেদের উপজাতি হিসেবে মেনে নিতে বিন্দুমাত্র আপত্তি করেননি। এমনকি এখনো উপজাতি কোটার সকল সুবিধা ভোগ করছেন উপজাতি পরিচয় দিয়ে। প্রকৃতপক্ষে, তখন এই ধরনের প্রশ্নই উঠেনি। কিন্তু এখন আদিবাসী ‘স্বীকৃতি’ না দিলে ওনাদের আর চলছে না!

কিন্তু প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, পাহাড়িরা আদিবাসী স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য কিনা? যদি যোগ্য হয়, তাহলে রাষ্ট্রকে অবশ্যই এই স্বীকৃতি দিতে হবে। জাতিসংঘ আদিবাসীর যে সংজ্ঞা দেয়, সে অনুযায়ী কোনো ভূখন্ডে বর্তমান শাসক গোষ্ঠীর পূর্বে প্রবেশকারী নির্দিষ্ট সংষ্কৃতির অবিকৃত ধারক জাতিগুলো আদিবাসী। কিন্তু, পাহাড়ের প্রায় সকল নৃ-গোষ্ঠিদের পার্শ্ববর্তী মায়ানমার কিংবা অন্যান্য দেশ থেকে আগমনকাল যে মাত্র দুই থেকে তিনশ বছর, সেটি জানার জন্য সিরিয়াস গবেষনার প্রয়োজন পড়ে না। ইতিহাস বলে, গত তিন থেকে সাড়ে তিন শ বছরের মধ্যে সিনলুন ও চীন (লুসাই,পাংখু,মোরো ও খুমি গোত্র) , ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য (ত্রিপুরা,মুরং,তঞ্চঙ্গা,রিয়ং), আরকান (চাকমা,মগ ইত্যাদি গোত্র ) থেকে এদের বাংলাদেশে আবির্ভাব ঘটেছে। তার বহুপূর্বে এই বঙ্গভূমে বাঙ্গালীরা নিজস্ব ভূমি স্থাপন করে ফেলেছে। আর ‘নির্দিষ্ট সংস্কৃতির অবিকৃত ধারক’-এই কথাটিও তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, এটি দিব্যদৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে। তবুও একটু ইতিহাস পর্যালোচনা করা যাক।

উপজাতীয় রাজাদের বংশক্রম থেকে দেখা যায়, চাকমাদের মধ্যে অনেক রাজাই মুসলিম ধর্মে ধর্মান্তরিত হন। তাঁরা মুসলিম নাম ও পদবি গ্রহন করতেন। এছাড়া তাঁদের সাথে মুসলিম বিবাহ-রীতির হুবহু মিল খুঁজে পাওয়া গেছে অপর একটি গবেষনায়। চাকমাদের ধর্ম বৌদ্ধ হলেও, ধর্মগত আচারে বৌদ্ধত্বের বিশেষ প্রমান পাওয়া যায় না। ১৮ শতকে বহু চাকমার মুসলিম হবার প্রমান রয়েছে। পরে আবার হিন্দুত্বের অনুপ্রবেশের চেষ্টা চলে। সর্বপ্রথম ব্রিটিশ আমলেই কালিন্দি রানী নামের তাঁদের এক রানী সকলকে বৌদ্ধ হবার নির্দেশ দেন। ১৮ শতাব্দীতে তাঁদের মধ্যে এতটাই বাঙালিয়ানা ভর করে যে, জে পি মিলস বলেন, ‘এরা আচারে-ব্যাবহারে ও সংস্কৃতিগত বিষয়ে খুবই বাঙালি হয়ে গেছে (Most Bangalaised tribes)’। আরেকটি গবেষনায় দেখা গেছে, চাকমা ভাষা বাংলা ভাষার একটি উপভাষা।

আশা করি আর প্রশ্ন নেই। তবু, অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে, পাহাড়িদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিলে কি এমন ক্ষতি হবে- আজ সেইসব নিয়েই আলোচনা করা হবে:

মূল সমস্যাটি হল আদিবাসী হিসেবে কাউকে স্বীকৃতি দেওয়া মানে জাতিসংঘের ‘আদিবাসীদের অধিকার সংরক্ষেনের ঘোষনাপত্র’টি মেনে নেওয়া এবং সেই অনুযায়ী বাস্তবায়ন করা। সেই ঘোষণাপত্রে কি আছে? কয়েকটি উদাহরন দেওয়া যাক।

এই ঘোষনা পত্র অনুযায়ী আদিবাসীদের স্বায়ত্বশাসনের অধিকার তৈরি হবে। (ধারা-৪, ধারা-১৮)

ধারা-৪ এ স্পষ্ট বলা আছে-

Indigenous peoples, in exercising their right to self-determination, have the right to autonomy or self-government in matters relating to their internal and local affairs, as well as ways and means for financing their autonomous functions.

ধারা-১৮ এ বলা হয়েছে-

Indigenous peoples have the right to participate in decision-making in matters which would affect their rights, through representatives chosen by themselves in accordance with their own procedures, as well as to maintain and develop their own indigenous decision-making institutions.

এই ঘোষনাপত্র অনুযায়ী পাহাড়ের সমূদয় প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের মালিকানা সরকারের নয়, বরং আদিবাসীদের হবে। (ধারা-২৬)

ধারা-২৬ এ তিনটি অংশ। এতে বলা আছে-

Indigenous peoples have the right to the lands, territories and resources which they have traditionally owned, occupied or otherwise used or acquired. Indigenous peoples have the right to own, use, develop and control the lands, territories and resources that they possess by reason of traditional ownership or other traditional occupation or use, as well as those which they have otherwise acquired. States shall give legal recognition and protection to these lands, territories and resources. Such recognition shall be conducted with due respect to the customs, traditions and land tenure systems of the indigenous peoples concerned.

ধারা-২৬

এই ঘোষনাপত্র অনুযায়ী পাহাড়ে আর কখনোই আদিবাসীদের অনুমতি ছাড়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সীমান্তরক্ষীবাহিনী প্রবেশ করতে পারবে না এবং আদিবাসী অঞ্চল সীমান্ত সংলগ্ন হলে, সীমান্তের ওপারে নিজেদের স্বার্থ-সংলিষ্ঠ ক্ষেত্রে যোগাযোগ ও বিভিন্ন সহযোগিতা স্থাপন করতে পারবে। দেশের সেনাবাহিনীকে আর্ন্তজাতিক কোনো কাজে নিয়োজিত করতে হলে অবশ্যই আদিবাসীদের অনুমতির দরকার হবে। (ধারা-৩৬)

ধারা-৩৬ এ দুইটি অংশ। এগুলোতে বলা হয়েছে:

Indigenous peoples, in particular those divided by international borders, have the right to maintain and develop contacts, relations and cooperation, including activities for spiritual, cultural, political, economic and social purposes, with their own members as well as other peoples across borders. States, in consultation and cooperation with indigenous peoples, shall take effective measures to facilitate the exercise and ensure the implementation of this right.

দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এসব শর্ত ছাড়াও আরও বেশ কিছু শর্ত এই ঘোষণাপত্রে রয়েছে। এর পরে নিশ্চয়ই বুঝতে বাকি নেই, কেন পাহাড়ি নেতারা এই ‘স্বীকৃতি’র পেছনে দৌড়াচ্ছে। ক্ষমতার লোভই এখানে মুখ্য। জাতিসংঘের এই ঘোষণাপত্র মেনে নেওয়ার পরিস্কার অর্থ হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে দেওয়া। বাংলাদেশ সরকার অন্তত এই ক্ষেত্রে সাধুবাদ পাবার যোগ্য, কারন সরকার জাতিসংঘের এই ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করে। যারা পাহাড়িদের বেশ কিছু অযৌক্তিক দাবীর পক্ষে বলতে গিয়ে যুক্তি দেখান যে, তাঁদের মূল উদ্দেশ্য স্বাধীনতা নয়, তাহলে তারা আগেই তা পেতে পারত। প্রকৃত সত্য হচ্ছে তারা সবসময় চেষ্টা করেছে, কিন্তু সফল হয়নি। পূর্ব পাকিস্তানের ভাগে তাঁদের ফেলা হলে, পাহাড়ি নেতারা রাঙ্গামাটিতে ভারত ও বান্দরবানে ব্রক্ষ্রদেশের পতাকা উড়ান। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে পুরোপুরি পূর্বপাকিস্তানের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তাঁদের সেই চেষ্টা ভেস্তে যায়।

শেখ মুজিবের আমলে, লারমারা ভারতের কাছে সাহায্যের জন্য আবেদন করে। ভারত সাহায্য তো করেইনি, উপরন্তু বাংলাদেশ সরকারের সাথে সুসম্পর্ক থাকায়, তা সরকারকে জানিয়ে দেয়। প্রেসিডেন্ট জিয়ার আমলে শান্তিবাহিনীকে ভারত কৌশলগতভাবে সাহায্য দেয়। নয়তো সীমান্তের এপার থেকে অভিযান চালানো হলে ওপারের সাহায্য ছাড়া টিকে থাকা অসম্ভব ছিল শান্তিবাহিনীর জন্য। জিয়ার সাথে ভারতের সম্পর্ক খুব খারাপ থাকায় জিয়া খুব কঠোরভাবে এই বিদ্রোহ দমন করেন। অথচ, এই জন্য জিয়াকে সমালোচনা করা হয়। এখনও তারা সেই চেষ্টা ছাড়েনি। বরং পশ্চিমাদের সাহায্য ও জাতিসংঘের মোড়কে তারা সেটি অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু বীর বাঙ্গালী এইসব অপ-তৎপরতা রুখে দাঁড়াবে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন