কেএনএফ আতঙ্ক

দীর্ঘ ৭ মাস ক্ষুধার্ত থেকে একাই সংগ্রাম করেন অন্ত:সত্ত্বা জিংপা বম

fec-image

মুখে রা নেই, বিমর্ষ। বেদনায় অনুধাবন শক্তি হারিয়েছেন কবেই। তারপরও দুই চোখ স্যাঁতসেঁতে। পেটে তখন সাত মাসের বাচ্চা। কষ্টের যন্ত্রণায় মুখে হাসি ফুটেনি। শুধু দু’চোখে অশ্রুভরা জল। এলাকার চারপাশে পাহাড়ের বিমূর্ষ গোলাগুলির শব্দ। সে শব্দের আতঙ্কে পুরো গ্রামটি ফাঁকা। পুরো গ্রাম সুনসান নিরব ও নিস্তদ্ধতা। ভয়ে গ্রামের মানুষরা পালিয়েছেন নির্জন জঙ্গলে, কেউ জুম ঘরে আবার কেউ সন্তান নিয়ে আত্মীয়দের বাসায় ঠাই নেয়। দীর্ঘ সাতমাস কখনো খেয়ে আবার সারাদিন ক্ষুধার্ত পেটে সন্তাদের আগলে রেখে গ্রামটিতে জীবনের সংগ্রাম ও যুদ্ধ চালিয়েছেন। তখন গর্ভের প্রসবের ব্যথায় চিৎকার করেছিলেন একাই। আশপাশে জঙ্গলে পালিয়ে থাকা গ্রামবাসীর চারজন শুনে ছুটে আসেন তার কাছে। ভয়ে-আতঙ্কে ভর রইলেও তাদের সহযোগিতায় ১ অক্টোবর শিশুটিকে পৃথিবীতে আলো দেখান জিংপা বম(৩০)। শিশুটির নাম রাখা হয় ড্রামফেন চাং বম, তার বয়স এখন দেড়মাস।

এমন হৃদয়স্পর্শী ঘটনাটি ঘটেছে রোয়াংছড়ি উপজেলার সদর ইউনিয়নের ৬নং পাইক্ষ্যং পাড়া গ্রামের জিংপা বম(৩০) নামে এক মায়ের সাথে। প্রায় দীর্ঘ সাতমাস পাইক্ষ্যং পাড়াতে ভয়, আতঙ্ক, দুঃখভরা কষ্টের জীবন নিয়ে নিজ সন্তানের জন্য গ্রামে একাই সংগ্রাম চালিয়ে এসেছিলেন এই নারী।

জিংপা বম(৩০), তিনি পাইক্ষ্যং পাড়াতে বসবাস করেন। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। স্বামী ভোয়ালিয়াং বম একজন কৃষক। জুম ও বাগানে ফলমূল চাষ করেই সংসার চলে। কিন্তু গেল এপ্রিল মাসে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট কেএনএফের নির্যাতন ও অত্যাচারের কারণে গ্রামে মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। একে একে সব পরিবার লোকজন গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে যান। কেউ ভয়ে জঙ্গলে আবার কেউ আত্মীয়দের বাসায় আশ্রয় নিয়েছেন। তখন জিংপা বম(৩০) পেটে সাতমাস ধরে গর্ভেধারণ করেছেন ড্রামফেন চাং বম নামে এক নবজাতকের। ভয়-আতঙ্কে তিনি বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাননি। এক মেয়ে ও নবজাতককে নিয়ে বাড়িতে থেকে গেছেন। দীর্ঘ সাতমাস একাকিত্বভাবে সেই গ্রামের জীবনযুদ্ধ চালিয়েছেন নিজ সন্তানের জন্য। কখনো ভাত খেয়েছেন কখনো বা না খেয়ে ক্ষুধার্ত সহ্য করে গ্রামের মধ্যে একাই রাত কাটিয়েছেন। দীর্ঘ আটমাস সংগ্রামের পর সে গ্রাম থেকে পালিয়ে যাওয়া লোকজন অনেকেই ফিরতে শুরু করেছেন। কিন্তু জিংপা বমের(৩০) কোন আনন্দ নেই। তিনি মনে করেন এখনো পুরো গ্রামে একাই বসবাস করছেন।

জীবন সংগ্রাম বিষয়ে কথা হয় জিংপা বমের সাথে। তিনি কান্নাকণ্ঠে বলেন, এলাকায় গোলাগুলির পর আতঙ্কে পাড়াবাসীরা সবাই পালিয়ে গেছে। আমার ছেলে-মেয়েকে নিয়ে কোথাও যেতে পারিনি। সন্তাদেরকে নিয়ে আমি পাড়াতে একা থেকে গেছি। যেহেতু পাড়াতে ঝামেলা হতে পারে সেজন্য বাবা-মা তারাও চলে গেছে। কখনো খেয়ে আবার কখনো না খেয়ে থাকতে হয়েছে। বাজারে যাওয়ার মানুষ নাই। কিন্তু একদিন গভীর রাতে আমার পেট ব্যাথা শুরু হয়। চিৎকার শুনে জঙ্গল থেকে ৪ জন মহিলা ছুটে আসেন। তারপর আমার ছেলে সন্তানের জন্ম হয়।

জিংপা বম বলেন, পাড়ায় একবারের চুপচাপ। কোন শব্দ নাই। টানা পাচঁ মাস কখনো খেয়ে, কখনো না খেয়ে কাটিয়েছি। মানুষজনের সাথে কথা বলব সেই সুযোগও হয়ে উঠেনি। তাছাড়া এখন ঘরে চাল নাই। বিভিন্ন সমস্যার কারণে জুমের ধান চাষ করতে পারিনি এবছরে। কী করব না করব কিছুই বুঝতে পারছি না।

রোয়াংছড়ি সদর থেকে পাইক্ষ্যং পাড়া গ্রামের দুরত্ব প্রায় ১২ কিলোমিটার। গ্রামের সবাই বম সম্প্রদায়ের বসবাস। গ্রামের পরিবারের সংখ্যা ৯৭টি। কিন্তু গ্রামে ফিরেছেন ৫৭ পরিবার। এখনো ৪০টি পরিবার ফিরে আসেনি। পাইক্ষ্যং পাড়াতে প্রবেশের মুখে জিংপা বমের(৩০) তার মাচাং ঘরটি। সেই ঘরের ভিতর তার ছেলে ড্রামফেন চাং বম দোলনায় ঘুমিয়ে আছেন। নবজাতক শিশুটি জানেই না তার মায়ের জীবনযুদ্ধের বিমর্ষ কথা। কী হয়েছে কী ঘটেছে গ্রামে মানুষদের সাথে! তবুও শিশুটির ফুটফুটে মুখে মুচকি হাসি। শিশুটি এখন তার মায়ের কোলে আরামে ঘুমিয়ে আছেন।

অন্যদিকে বাড়িতে দেখা দিয়েছে খাবার সংকট। নির্দিষ্ট সময়ে জুম চাষ করতে না পেরে তার বড় দিদির কাছ থেকে দশ হাড়ি ধান ধার নিয়েছেন। সে ধান দিয়ে কোনমতে সংসার টেনে চালাচ্ছেন। টানা আটমাস কোন কৃষিপণ্য উৎপাদন করতে পারেন নি। এই ধান শেষ হলে কী রকবেন সেটি নিয়ে চিন্তায় ঘুরপাক খাচ্ছেন তিনি।

তার স্বামী দলিয়ান বম বলেন, খুব কষ্টের মধ্যে দিন যাচ্ছে আমাদের। ঘরে ধান নাই, খাবার নাই। মানুষের কাছে থেকে কয়েক হাড়ি ধান ধার নিয়েছি, এইটা শেষ হলে কী করব জানি না। আগের মত শান্তি ফিরে আসলে গ্রামবাসীদের জন্য খুব ভালো হবে।

পাইংক্ষ্যং পাড়ায় ফিরে আসা পারভিময় বম নামে আরেক মায়ের সাথে কথা হয় পার্বত্যনিউজের প্রতিবেদকের সাথে, তিনি বলেন, পাশের এক পাড়ায় (রৌনিন পাড়া) তিনজনের মৃত্যুর খবর পেয়ে ভয়ে একসাথে পনেরো পরিবার পালিয়ে যান। তারও দুটি সন্তান ছিল। হাঁটতে না পারায় বেশি দূরে পালাতে পারেননি। পাড়ার পাশের একটা জঙ্গলে লুকিয়ে ছিলেন। খাবার ফুরিয়ে গেলে রাতের অন্ধকারে পাড়ায় এসে ধান-চাল নিয়ে যেতেন।

পাড়ার পাশে লুকিয়ে থাকা লালকিম বম (৭৫) বলেন, গ্রামের সবাই পালিয়েছিল। মেয়েটি তার সন্তানদের নিয়ে গ্রামের মধ্যে একাই বাড়িতে ছিল। বাচ্চা হওয়ার আগে মাত্র চারজন সাথে ছিলাম। আমরা চাই গ্রামে আগের মতো শান্তি ফিরে আসুক।

রোয়াংছড়ি সদর ইউনিয়নের ৩৪১নং পাইক্ষ্যং মৌজাতে গ্রাম রয়েছে ১২টি। শংখ মনি পাড়া, রনিন পাড়া, মুনরেম পাড়া, লুংলেই পাড়া, ব্যাঙছড়ি মারমা পাড়া, রেপু তংচগ্যা পাড়া, ব্যাঙছড়ি পূর্ণবাসন পাড়া, কাপ্লাং পাড়া, খামতাং পাড়া ও পাইক্ষ্যং পাড়া ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তাছাড়া সেসব গ্রামের লোকজনদের মাঝে খাবার সংকট দেখা দিয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: কেএনএফ, জিংপা বম, সংগ্রাম
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন