হঠাৎ বান্দরবানের হোটেল-মোটেলের বুকিং বাতিল, নেপথ্যে কী

fec-image

ঈদের ছুটি আর নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণকে কেন্দ্র করে পার্বত্য তিন জেলার মধ্যে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি পর্যটকদের আনাগোনায় মুখরিত হবে এমনটি আশা করা হলেও ব্যতিক্রম হতে যাচ্ছে বান্দরবানে।

অন্য দুই জেলায় হোটেল-মোটেল ও রিসোর্টে ‘প্রত্যাশা মতো বেশ ভাল’ অগ্রিম বুকিং পেলেও বান্দরবানে পর্যটকরা বুকিং বাতিল করে দিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন পর্যটন ব্যবসায়ীরা।

কী কারণে এই অবস্থা হচ্ছে- জানতে চাইলে বান্দরবান আবাসিক হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম বলেন, “রুমা ও থানচির ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যৌথ অভিযানকে কেন্দ্র বুকিং বাতিল হচ্ছে। খুব আশঙ্কাজনক হারে বুকিং বাতিল হচ্ছে শুনলাম।”

এবার রোজার ঈদ আর পাহাড়ে বর্ষবরণ উৎসব বৈসাবি উদযাপন করা হচ্ছে প্রায় একই সময়ে। ঈদের একদিন পরে বিভিন্ন আনুষ্ঠানিককতায় শুরু হচ্ছে পাহাড়ে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর এই বর্ষবরণ উৎসব।

পাহাড়ে বর্ষবরণ উৎসবটি ১১টি নৃগোষ্ঠী একেক নামে, একেক রঙে, একেক আনুষ্ঠানিকতা পালন করে থাকে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, গান, নাচ এবং হরেক রকমের খাবার পরিবেশনায় টানা কয়েক দিন ধরে চলে এসব আয়োজন।

আর সে উৎসবের সঙ্গে এবার বাড়তি যোগ হল পহেলা বৈশাখও। ছুটির আনন্দ কাটাতে বরাবরই বান্দরবান ছিল অনেকের পছন্দের জায়গা। ঘুরে বেড়ানোর জন্য এতদিন মুখিয়েও ছিলেন লোকজন। কিন্তু সে আশায় যেন এখন গুড়েবালি।

‘হিল ভিউ’ নামে একটি আবাসিক হোটেলে এবার ঈদ এবং বৈসাবি ঘিরে কোনো বুকিং নেই। বুকিং যা ছিল সবকটাই বাতিল হয়েছে বলে জানান ব্যবস্থাপক লিমন সরকার।

বুধবার সন্ধ্যায় তিনি বলেন, “দুটি উৎসব ঘিরে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত অগ্রিম বুকিং ওঠেছিল। শতভাগ না হলেও শেষ পর্যন্ত ৮০ শতাংশ পর্যন্ত বুকিং হত। এখন রুমা ও থানচির ঘটনায় সবকটাই বাতিল হয়ে গেছে। কোনো অগ্রিম বুকিং নেই। ঈদের দিন হঠাৎ করে কেউ আসলে আসতে পারে।”

২ এপ্রিল রাতে এবং ৩ এপ্রিল দুপুরে বান্দরবানের রুমা এবং থানচি উপজেলার কৃষি ও সোনালী ব্যাংকের তিনটি শাখায় হামলা চালায় সশস্ত্র লোকজন। তারা টাকা লুট করে, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মারধর করে, একজন ব্যাংক ব্যবস্থাপককে অপহরণ করে নিয়ে যায়। লুট করে বেশ কিছু অস্ত্র ও গুলি।

রুমায় সোনালী ব্যাংকে হামলা-ডাকাতি এবং ব্যবস্থাপক নেজাম উদ্দিনকে অপহরণের ঘটনাটি মঙ্গলবার রাতে প্রথম ভাগে ঘটলেও; থানচিতে কৃষি ও সোনালী ব্যাংকে হামলা হয়েছে ভরদুপুরে।

দুটি ঘটনাতেই পাহাড়ের সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট-কেএনএফ এর নাম এসেছে; যারা পাহাড়ে ‘বম পার্টি’ নামে পরিচিত।

এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার যৌথ অভিযান পরিচালনার ঘোষণা দেয়। যৌথ অভিযানে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ পাহাড়িদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক ও ভয় তৈরি হয়। রাস্তাঘাটে স্থানীয় মানুষজনের চলাচলও কমে এসেছে। সে থেকেই পাহাড়ের বাইরের পর্যটকরা ঈদ ও বর্ষবরণের লম্বা ছুটিতেও বান্দরবানে আসতে ভয় পাচ্ছেন বলে মনে করছেন পর্যটন ব্যবসায়ীরা।

জেলা শহরের প্রবেশমুখে মেঘলাস্থ পর্যটন মোটেলের ব্যবস্থাপক মো. শোয়েব বলেন, “এ মাসের শুরুতে ঈদ উপলক্ষে ৮০ ভাগ অগ্রিম বুকিং হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ রুমা ও থানচির ঘটনা বুকিং বাতিল হতে হতে ৩০ ভাগে নেমে আসে। কয়েক দিনেই ৫০ ভাগ বুকিং বাতিল হয়ে যায়।

“আমরা তাদেরকে বলেছি, যেসব এলাকায় এসব ঘটনা ঘটেছে তা শহর থেকে অনেক দূরে। শহরে এসবের কোনো প্রভাব নেই। তারপরও বুকিং বাতিল করে ফেলে তারা। বিশ্বাস করতে চায় না।”

ব্যবস্থাপক শোয়েব বলেন, “আবার বেশি আগ বাড়িয়ে বললে মনে করবে, শুধু ব্যাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে এগুলো বলা হচ্ছে। যে কেউ শহরে আশপাশে পর্যটন স্পটে ঘুরে আসতে পারেন। সেখানে কোনো সমস্যা নেই।”

মেঘলা এলাকায় হলি ডে ইন রিসোর্টের ব্যবস্থাপক তৌহিদুল আলম বলেন, “এবার বৈসাবি এবং ঈদ একসঙ্গে পড়েছে। ভাল গেস্ট আসবে মনে করা হয়েছিল। ১ এপ্রিল পর্যন্ত ৪০ শতাংশ বুকিং ছিল। পরে রুমা ও থানচি ঘটনার জন্য বুকিং বাতিল করে দেয়।

“এখন আবার কিছু বুকিং হচ্ছে, কিছু বাতিল হচ্ছে। মনে হয় না আর গেস্ট সেভাবে আসবে। ঈদ এবং বৈসাবি হিসেবে যেভাবে বুকিং হওয়ার কথা সেভাবে তো হয়নি। বেশির ভাগ ভয়ে আসতে চাচ্ছে না।”

তার জন্য সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকা ‘দায়ী’ বলে মনে করেন তৌহিদুল। কারণ হিসেবে বলছিলেন, “মূলত রুমা ও থানচিতে উত্তেজনা হলেও নিউজের প্রথম শিরোনামে বান্দরবান থাকে। বান্দরবান শিরোনাম দেখেই বুকিং বাতিল করে ফেলে সবাই। আর কেউ আসতে চায় না। তাদেরকে বুঝিয়েছি কিন্তু কাজ হয়নি।”

তবে কিছু অগ্রিম বুকিং পাওয়ার কথা জানান আবাসিক হোটেল ‘আরণ্যক’ এর পরিচালক জসিম উদ্দিন।

তিনি বলেন, “রুমা-থানচির ঘটনার প্রভাবে একের পর এক বুকিং বাতিল হতে থাকে। তাদেরকে বুঝিয়েছি এগুলো শহর এলাকা থেকে অনেক দূরে। এসব ঘটনায় শহরে তেমন প্রভাব নেই। পরে কিছু অগ্রিম বুকিং আসতে থাকে।

“এই পরিস্থিতিতে যেটুকু বুকিং পেয়েছি এত খারাপ বলব না। কিন্তু ঈদ, পহেলা বৈশাখ এবং পাহাড়িদের সাংগ্রাই, বিজু উৎসবের এলাকা হিসেবে এসব অগ্রিম বুকিং কিছুই না”, বলেন জসিম উদ্দিন।

এক সপ্তাহ আগে খবর নিয়ে গড়ে সব হোটেল-মোটেল-রিসোর্টে ৭০ শতাংশ বুকিংয়ের কথা জেনেছিলেন উল্লেখ করে বান্দরবান আবাসিক হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম বলেন, “খুব আশঙ্কাজনক হারে বুকিং বাতিল হচ্ছে শুনলাম। যদিও বা ঘটনাস্থল শহর এলাকা থেকে অনেক দূরে। এখানে তেমন কোনো প্রভাব নেই। শহর থেকে রুমা ৪৭ কিলোমিটার দূরে আর থানচির দূরত্ব ৮৫ কিলোমিটার।

“তারপরও মানুষ ভয় পায়। হয়ত মনে করে, বেড়াতে গিয়ে কোনো অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় কিনা। শহরের আশপাশে যত পর্যটন স্পট রয়েছে সেখানে ঘুরে যেতে তো কারও সমস্যা নেই”, আক্ষেপ নিয়ে বলেন সিরাজুল ইসলাম।

পাহাড়ে যারা ভ্রমণে যান, বিশেষত দুর্গম এলাকায় তাদের জন্য স্থানীয় গাইড অনেকটাই বাধ্যতামূলক। বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর সদস্যরাই এই কাজ করে থাকেন। এটা অনেকের কর্মসংস্থানেরও উপায়। কিন্তু ‘পর্যটক-খরায়’ তাদের ভুগতে হচ্ছে অনেকদিন ধরেই।

এর কারণ হিসেবে গাইডরা বলছিলেন, ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট-কেএনএফ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘাতের জেরে চার উপজেলা দফায় দফায় নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে। বিশেষ করে রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি ও আলীকদম উপজেলায় স্থানীয় ও বিদেশি পর্যটকের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ছিল প্রশাসনের পক্ষ থেকে।

যদিও পরে তা ধীরে ধীরে উঠে যায়। কিন্তু সেই ‘ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার’ রেশ কাটতে না কাটতেই আবার ‘নতুন বিপদ’ সামনে এসেছে। এতে পর্যটন ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি গাইডরাও ক্ষতির মুখে পড়েন।

থানচি উপজেলার স্থানীয় এক পর্যটক গাইড বলছিলেন, “২০০ জনের বেশি পর্যটক গাইড রয়েছেন। বিশেষ পরিস্থিতির কারণে ‘ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞ’ না দিলেও এখনকার পরিস্থিতি নিষেধাজ্ঞারই মতই। প্রশাসন থেকে বলা হয়েছে, কেউ আসতে চাইলে নিরুৎসাহিত করার। কিন্তু এমনিতেই কেউ চাইবে না।”

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ট্যুরিস্ট পুলিশের বান্দরবান জোনের পুলিশ সুপার মঞ্জুর মোরশেদ বলেন, “আবাসিক হোটেল-মোটেলে খবর নিয়েছি, সবাই একই রকম কথা বলছে। কোনো বুকিং নেই। বুকিং যা ছিল তাও বাতিল হয়ে যাচ্ছে। এবার কোনো পর্যটক থাকবে বলে মনে হয় না।

“আমাদের ধারণা, এবার কেবল স্থানীয় লোকজনই শহরে কয়েকটি পর্যটন স্পটে ঘুরে বেড়াবে। তারপরও যারাই আসুক সবার নিরাপত্তা জন্য স্পটে স্পটে নিয়মিত টহল থাকবে”, বলেন মঞ্জুর মোরশেদ।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: কেএনএফ, পাহাড়ে পর্যটন, বম পার্টি
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন