সড়কে পিষ্ট হলো মেধাবী ছাত্র সিজানের মা-বাবার স্বপ্ন

fec-image

ছোট বেলা থেকেই সদাহাস্যেজ্জ্বল, অত্যান্ত পরোপকারী ও মিষ্টিভাষী ছিলেন সিয়ামুর রহমান সিজান (২২)। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে সকলস্তরের বন্ধু-বান্ধব এবং এলাকার সাধারণ মানুষের সাথেও নম্রভাবে হাসিমুখে কথা বলতেন তিনি। নিজের জন্মস্থানে কারও সাথে ব্যক্তিগত কোন ধরণের বিরোধ ছিল না। আকস্মিকভাবে এমন কিছু দুর্ঘটনা ঘটে যা একটি পরিবারের সারাজীবনের সব স্বপ্ন ভেঙে ভবিষ্যৎ চলে যায় অনিশ্চয়তায়। বলেছিলাম কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার কাকারা ইউনিয়নের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয়া জহিরুল ইসলাম ও ইসরাত খায়ের তালুকদার দম্পতির একমাত্র ছেলে সিজানের কথা।

সিয়ানুর রহমান সিজান চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা শেষ করে পরিবারের হাল ধরবেন। তার সেই স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল। এক সড়ক দুর্ঘটনায় কেড়ে নিল তার স্বপ্ন। একটি সড়ক দুর্ঘটনায় তার স্বপ্ন এ ভাবে কেড়ে নিবে হয়তো তিনি কখনো ভাবেন নি। স্বপ্ন পূরণের আগেই সড়ক দুর্ঘটনায় পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন তিনি।

গত বুধবার দুপুর আড়াইটার দিকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া উপজেলার মধ্যবর্তী ঠাকুরদীঘি স্টেশন এলাকায় যাত্রীবাহী সৌদিয়া ও পূর্বানী বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে ঘটে। এসময় ১২ জন যাত্রী আহত হয়েছেন। এতে চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির মেধাবী শিক্ষার্থী চকরিয়ার সন্তান সিজান (২৩) সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়। আহত সিজানকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আনোয়ার খাঁন মডার্ন হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নেয়া হয়েছিল। হাসপাতালে চিকিৎসা অবস্থায় তিন দিন পর শুক্রবার সকালের দিকে মৃত্যুবরণ করেন। শুক্রবার বাদে এশা কাকারা হজরত শাহ উমর (র.) মাজার প্রাঙ্গণে নিহত সিজানের নামাজে জানাজা পরবর্তী মাজার সংলগ্ন সামাজিক গোরস্থানে দাফন করা হয় তাকে।

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত সিজান চকরিয়া উপজেলার কাকারা ইউনিয়নের জহিরুল ইসলামের ছেলে। তাঁর বাবা কুমিল্লায় কর্মরত দি একমি ঔষুধ কোম্পানির কর্মকর্তা।

দেশে প্রতিদিন কোথাও না কোন এলাকায় ঘটে চলছে সড়ক দুর্ঘটনা। তারমধ্যে সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হলো শিক্ষার্থীরা। এই সড়ক দুর্ঘটনায় হারিয়ে যাচ্ছে অনেক সুপ্ত প্রতিভা ও দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। একজন শিক্ষার্থী এবং তার পরিবার চোখে ধরে রাখে হাজারো স্বপ্ন ও আশা। শুধু নিজের পরিবার নয়, তার সমাজের চাওয়া-পাওয়াও কম নয়। ঠিক একজন শিক্ষার্থীর মৃত্যুও শুধু তার পরিবারের স্বপ্ন ভঙ্গ নয়, সমাজের আশা আকাঙ্খার জলাঞ্জলি। অনকাঙ্ক্ষিতভাবে এই মৃত্যু শুধু একটি জীবনের পরিসমাপ্তি নয় তার সঙ্গে শিক্ষার্থীর পুরো পরিবারের ভবিষ্যৎ চলে যায় অনিশ্চয়তায়। অনেক পরিবার হারায় তাদের একমাত্র বেঁচে থাকার অবলম্বনও।

এদিকে, চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটিতে পড়ুয়া নিহত মেধাবী শিক্ষার্থী সিজানের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে পুরো এলাকাজুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে। তার মৃত্যুকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার ব্যক্তিরা শোক বার্তায় ঝড় তুলেছে। সিয়ামের সহপাঠী আবরার লিখেছেন “এটা দুর্ঘটনা না, একটি পরিবারের স্বপ্নকে চুরমার করে দেওয়ার যন্ত্রণা। এভাবে সড়ক দুর্ঘটনায় যেন আর কোনো বাবা-মার কোল খালি না হয়। কোন পরিবারের স্বপ্ন ও আশা যেন এভাবে আর ধ্বংস না হয়’।
সিজানের মরদেহ হাসপাতাল থেকে নিজ বাড়িতে নিয়ে আসলে পুরো এলাকাজুড়ে হৃদয়বিদারক এক মর্মস্পর্শী দৃশ্যে দেখা মেলে। তাঁকে একনজর দেখতে আত্মীয়, সহপাঠীরা তাদের বাড়িতে ভিড় জমান। স্কুল ও শৈশবের অনেক বন্ধু তার মরদেহ দেখে দেখে নিরবে চোখের জল ফেলে কাঁদছে।

সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, নিহত সিয়ামুর রহমান সিজানের ছিল এক ভাই, দুই বোন। সিজান ছিল পরিবারের বড় সন্তান। তার দুই বোন ছিল সিজানের ছোট। পরিবারের সবার বড় সিজান। তাঁর ছোট দুই বোন হলেন, নওরিন রহমান দিয়া ও সারা। বড় ভাইকে হারিয়ে সিজানের কলেজ পডুয়া ছোট বোন দিয়া’র কান্না কেউ থামাতে পারছেনা। পাঁচ বছর বয়সী বোন ছোট্ট সারা এখনো জানতে পারেনি তার বড় ভাই এ পৃথিবীর বুকে আর বেঁচে নেই। ভাই-বোনের বন্ধন হঠাৎ এভাবে বিষাদে পরিণত হবে তা কখনো ভাবেনি বোন দিয়া। ভাইকে হারিয়ে অঝোর নয়নে কেঁদে যাচ্ছে। আদরের বড় ভাইকে ঘিরে ছিল ছোট বোন দিয়া’র আকাশসম নানা স্বপ্ন। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনায় তার সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল।

বাবা জহিরুল ইসলাম ও মা ইসরাত খায়ের তালুকদার দম্পতির একমাত্র ছেলে সিজানকে নিয়েই ছিলো তার বাবা-মায়ের যত স্বপ্ন। সেই ছেলেকে হারিয়ে বাবা ও মা পাগলপ্রায়। কথা বলার মত ভাষাও তারা হারিয়ে ফেলেছেন। কথা বেরোনোর আগেই বার বার কান্নায় ভেঙে পড়ছেন তার গর্ভধারনী মা। এভাবে অকালে সন্তানকে হারাতে হবে সে কখনো ভাবেনি। পরিবারের সদস্যদের চোখের সামনেই ভাইয়ের মুখ ভেসে ওঠে বোনের। তাকে ঘিরে বাবার স্বপ্ন ছিল অনেক। মানুষের মত মানুষ করবে, বড় হয়ে বাবার মুখ উজ্জ্বল করবে এটাই ভাবতেন তার বাবা। ছেলের মৃত্যুতে সব আশা শেষ হয়ে গেছে। দাফনপর্ব শেষ হলেও প্রিয় সন্তান হারানো মায়ের মনে জমে আছে শোকের মেঘ। একটি দুর্ঘটনায় নিভে গেল পুরো একটি পরিবারের সব স্বপ্ন ও আশা।

নিহত শিক্ষার্থী সিজানের চকরিয়া গ্রামার স্কুলের শিক্ষক জাহেদুল ইসলাম বলেন, তিনি সিজানকে হাতে-কলমে শিক্ষা দিয়েছেন। পড়াশোনায় খুবই ভালো ছিল। খুবই নম্রভাবে কথা বলতেন। সে বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। কোন পাঠদান অল্পতেই নিজের আয়ত্বে সেইভাবে তৈরি করে নিতে পারতো। হঠাৎ জানতে পারলাম সিজান সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে মারা যান। তাঁর এই মৃত্যুতে সত্যি খুবই ব্যথিত ও মর্মাহত হলাম। তাকে আল্লাহ পাক জান্নাতবাসী করুক।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: সড়ক, স্বপ্ন
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন