কারা এই কেএনএফ, তাদের নতুন হামলার নেপথ্যে কী

fec-image

ফেসবুকে পেজ খুলে বছর দু-এক আগে পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। পাহাড়ের দুই জেলার ৯ উপজেলা নিয়ে একটি আলাদা রাজ্য গঠনের ঘোষণাও দেয় তারা। কয়েকটি সশস্ত্র অভিযান চালিয়ে চাঁদাবাজি এবং হত্যার অভিযোগ উঠতে থাকে শুরু থেকেই।

একপর্যায়ে ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। এরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র সংঘাত হয় বার কয়েক। এরপর সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় ফেরে দলটি। আগামী ২২ এপ্রিল সেই আলোচনায় আবার বসার কথা ছিল। কিন্তু এর আগেই পাহাড়ের দুই ব্যাংকের তিন শাখায় ডাকাতি করে সশস্ত্র গোষ্ঠীটি। এখন শান্তি আলোচনার উদ্যোক্তারাও আর এ উদ্যোগ এগিয়ে নিয়ে যেতে চান না। তাই এক অনিশ্চয়তা, ত্রাসের আবহ তৈরি করেই রইল কেএনএফ।

বান্দরবানের দুই উপজেলায় ১৭ ঘণ্টার ব্যবধানে দুই ব্যাংকের তিন শাখায় ডাকাতির ঘটনা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, অন্তত দুই বছর আগে থেকে সক্রিয় সশস্ত্র এসব হামলার সঙ্গে যুক্ত।

বান্দরবানের রুমা উপজেলা সদরে মঙ্গলবার রাতে, পরদিন গতকাল বুধবার একেবারে দিনদুপুরে দু–দুটি ব্যাংকে হামলা মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে থানচি থানায় গুলি চালায় সন্ত্রাসীরা। এ গোষ্ঠীর সামর্থ্য, বিস্তৃতি ও সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধির একটা ইঙ্গিত এসব হামলার মধ্যে দিয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের অনেকেই। এতে পার্বত্য অঞ্চলের কিছু অংশে নতুন করে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হতে পারে বলেও তাঁদের ধারণা। এসব প্রশ্নের উত্তরের আগে সশস্ত্র এই গোষ্ঠীর উদ্ভব ও তৎপরতা নিয়ে একটু পেছনে ফেরা যাক।

২০২২ সালের গোড়ার দিকে কেএনএফের নাম নজরে আসে, আসতে থাকে তাদের নানা তৎপরতার খবর। মূলত ফেসবুকে পেজ খুলে এই গোষ্ঠী তাদের অস্তিত্বের জানান দেয়। সঙ্গে ছিল সশস্ত্র তৎপরতা। বান্দরবানের বম জাতিগোষ্ঠীর কিছু ব্যক্তি এটি গড়ে তুলেছেন বলে প্রাথমিকভাবে জানা যায়। কেএনএফ ফেসবুক পেজে দাবি করে, রাঙামাটি ও বান্দরবান অঞ্চলের ছয়টি জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছে তারা। সেগুলো হলো বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, ম্রো ও খুমি। তারা রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি এবং বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদম—এই উপজেলাগুলো নিয়ে আলাদা রাজ্যের দাবি করে। তাদের কল্পিত সেই ‘রাজ্যের’ মানচিত্রও তাদের পেজে দিয়ে দেয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করা একাধিক বিবৃতিতে কথিত এই সংগঠন জানায়, কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) নামে একটি সশস্ত্র দল গঠন করেছে তারা। তাদের মূল সংগঠনের সভাপতি নাথান বম।

কেএনএফ সেই সময় দাবি করেছিল, তাদের সামরিক শাখার শতাধিক সদস্য গেরিলা প্রশিক্ষণের জন্য মিয়ানমারের কাচিন প্রদেশে পাড়ি জমান বছর তিনেক আগে। ২০২১ সালে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একটি দল ফিরে আসে। ২০২২ সালে তারা আত্মগোপনে চলে যায়। তবে একাধিক সূত্র বলছে, কেএনএফের সশস্ত্র সদস্যের সংখ্যা শুরুতে খুব বেশি ছিল না। তখন হয়তো ১৫ থেকে ২০ জনের মতো সদস্য ছিল। কিন্তু পরে তাদের সংখ্যা বাড়ে।

কেএনএফের প্রধান হিসেবে যে নাথান বমের কথা বলা হয়, তিনি রুমা উপজেলার এডেন পাড়ার অধিবাসী। নাথান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের স্নাতক। রুমার এডেন পাড়ায় কুকি-চিন ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (কেএনডিও) নামের একটি বেসরকারি সংগঠনেরও প্রতিষ্ঠাতা তিনি। তবে তিনি এখন কোথায় আছেন, সেটা জানা যায়নি। এডেন পাড়ার বাসিন্দা নাথান বমের এক প্রতিবেশী ২০২২ সালের মে মাসে জানিয়েছিলেন, নাথানকে মাস তিনেক ধরে এলাকায় দেখা যাচ্ছে না।

জঙ্গিদের প্রশিক্ষণে কেএনএফ
পাহাড়ে কেএনএফের আস্তানায় সমতলের নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়ার সদস্যরা সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছিল বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এর আগে গণমাধ্যমকে জানিয়েছিল। ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে কেএনএফের সম্পর্কের কথা জানা যায়। রুমা উপজেলার ভারত ও মিয়ানমার সীমান্তসংলগ্ন এলাকার সালাপৌপাড়ার কাছের কোনো স্থানে কেএনএফের আস্তানা ছিল বলে মনে করা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গত বছর অভিযান চালিয়ে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়া ও কেএনএফের বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে।

এখন কেএনএফের অবস্থা কেমন
দুই বছরে অন্তত নয়টি বড় ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটিয়েছে কেএনএফ। গত বছর কেএনএফের সন্ত্রাসীদের চারটি হামলার ঘটনায় পাঁচ সেনাসদস্য নিহত হন। আরেক সশস্ত্র গোষ্ঠী ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) সঙ্গে সংঘর্ষে গত বছর রোয়াংছড়ি উপজেলার খামতাংপাড়া এলাকায় আটজন এবং রুমা উপজেলার মুয়ালপিপাড়া একজন নিহত হন। এ ছাড়া গত বছরের ৮ মে রোয়াংছড়ি উপজেলা পাইংখিয়ংপাড়া এলাকায় আওয়ামী লীগের একজন নেতাসহ বম জনগোষ্ঠীর তিনজন এবং ২০২৩ সালের ২২ মার্চ একই উপজেলার রামথারপাড়ায় থংচুল বম নামের এক কারবারিকে (পাড়াপ্রধান) গুলি করে হত্যা করা হয়। ২০২২ সালের ২১ জুন রাঙামাটির বিলাইছড়ির বড়থলি ইউনিয়নের সাইজাম পাড়ায় তিন ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যখন জঙ্গিদের সঙ্গে কেএনএফের সম্পর্ক নিশ্চিত হয়ে অভিযান চালায়, তখন বিশেষ করে রুমা, থানচিসহ পাহাড়ের বিভিন্ন এলাকা কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে। ওই সব অঞ্চলে পর্যটন বন্ধ হয়ে থাকে দীর্ঘ সময় ধরে। বমদের কেউ কেউ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের মিজোরামে চলে যান। বম জাতিগোষ্ঠীর সাধারণ মানুষ বিপাকে পড়েন। এ সময়টার সুযোগ নেয় কেএনএফ। আর তখন নতুন করে বেশ কিছুসংখ্যক যুবককে তারা দলে ভেড়ায় বলে স্থানীয় একাধিক সূত্র জানান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই সূত্র বলে, এখন কেএনএফ দাবি করে তাদের সদস্যসংখ্যা সাত শতাধিক। এতটা না হলেও কাছাকাছি হবে বলে তাঁদের ধারণা।

পাহাড়ে নানা সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতা
স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে গত শতকের সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র লড়াই শুরু করে। তাদের সশস্ত্র শাখা শান্তিবাহিনী নামে পরিচিত ছিল। দুই দশকের বেশি সময় ধরে চলা এই সশস্ত্র আন্দোলন শেষ হয় ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি হওয়ার পর। সশস্ত্র লড়াইয়ের এ সময়ে গরম বাহিনীসহ পাহাড়ে ছোট ছোট কয়েকটি সশস্ত্র গ্রুপ সৃষ্টি হয়। তবে তারা বেশি দিন টেকেনি। চুক্তির পর চুক্তিবিরোধী পাহাড়ি তরুণদের একটি গোষ্ঠী ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) নামের একটি সংগঠন গড়ে তোলে। তাদের সঙ্গে জেএসএসের সংঘাত আজও থামেনি।

এর মধ্যে ২০০৭ সালে জেএসএসের একটি অংশ মূল দল থেকে বের হয়ে জেএসএস (লারমা) নামে আরেকটি সংগঠন গড়ে তোলে।

২০১১ সালের মাঝামাঝি সময় ম্রো ন্যাশনাল পার্টি (এমএনপি) নামের একটি দল গড়ে ওঠে বান্দরবানের আলীকদমে। খুন, অপহরণসহ নানা সন্ত্রাসী কাজে জড়িয়ে পড়ে দলটি। এরপর ২০১৫ সালের নভেম্বরে দলটির ৭৯ জন সদস্য একযোগে আত্মসমর্পণ করেন। এরপর দলটির তৎপরতা বন্ধ হয়ে যায়। ওই বছরই আলীকদমে ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠীর কিছু তরুণ সদস্যকে নিয়ে আরেকটি সশস্ত্র দল গঠিত হয়। এর প্রধান রুংজুমা ত্রিপুরা প্রতিবেশী একটি দেশে চলে গেছেন বলে এলাকায় প্রচার আছে। ওই দলেরও এখন কোনো তৎপরতাও নেই।

২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক নামে আরেক দল গড়ে ওঠে। ইউপিডিএফের কর্মীদের হত্যা ও হামলার মধ্যে দিয়েই দলটির প্রকাশ ঘটে।

২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আগে বান্দরবানে ‘মগ পার্টি’ নামে একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতা শুরু হয়। মারমা জাতিগোষ্ঠীর কিছু সদস্য এ দল গঠন করে বলে স্থানীয় সূত্র থেকে জানা গেছে। সর্বশেষ আত্মপ্রকাশ করে কেএনএফ।

কেএনএফের এ তৎপরতার প্রভাব কী হতে পারে
পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত ছিলেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম। তিনি বলেন, কেএনএফের নতুন করে এই হামলার বড় ধরনের প্রভাব আছে। এর ফলে পাহাড়ে, বিশেষ করে কেএনএফ অধ্যুষিত এলাকাগুলোর শান্তি অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে গেল। তাঁর ধারণা, কেএনএফের সঙ্গে হয়তো পাহাড়ের আর কোনো বড় সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে নতুন যোগাযোগ সৃষ্টি করেছে। বড় গোষ্ঠী চাইছে না এখনই শান্তি আলোচনায় যাক কেএনএফ। কারণ, এতে তাদের প্রভাববলয় নষ্ট হয়ে যাবে।

কেএনএফের সশস্ত্র তৎপরতার সঙ্গে ভারতের মণিপুরের কুকিদের সঙ্গে স্থানীয় মেইতেইদের সঙ্গে চলমান সশস্ত্র বিরোধ, মিয়ানমারের বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে সরকারি বাহিনীর অব্যাহত সংঘাতকে দূরে রাখার অবকাশ নেই বলেই মনে করেন এমদাদুল ইসলাম।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: কেএনএফ, পার্বত্য চট্টগ্রাম
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন